
বিপিনবাবুর বিপদ - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের চব্বিশতম আখ্যান
- 10 May, 2025
- লেখক: মনীষা নস্কর
এপর্যন্ত পড়া অদ্ভুতুড়ে সিরিজে গোটাকতক বাদে বাকি সবগুলো পড়েই ‘অ্যাঁ! কি অদ্ভুত!’ এমন গোছের রিঅ্যাকশন হয়েছে। কোথাও আকাশ থেকে নেমে আসে ভীষণ হ্যান্ডসাম এলিয়েন, কোথাও ভূত এসে অঙ্ক কষে দেয়, কোথাও কাকাতুয়া বলে দিচ্ছে গুপ্তধনের সন্ধান.. এলিয়েন, ভূত আর গুপ্তধন— এই তিনটি জিনিস বারেবারে ঘুরেফিরে এসেছে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের প্লটগুলোয়। চব্বিশ নম্বর অদ্ভুতুড়ে ‘বিপিনবাবুর বিপদ’-এ মজুত এই তিন এলিমেন্টই।
নফরগঞ্জের বিখ্যাত হাড়কিপটে হলেন বিপিনবাবু। তাঁর বাড়িতে মানুষ দূরের কথা, কাকপক্ষী কুকুর বেড়ালও ঘরের চৌকাঠ মাড়ায় না। তিনি শুধু কিপটেই নন, তাঁর দুঃখবিলাসিতার স্বভাবটিও পুরোদস্তুর আছে। নিজেকে সেরা দুঃখী ভেবে তিনি আনন্দ পান। ঘরের দরজা এঁটে বসে ভাবতে থাকেন তাঁর চেয়ে বেশি দুঃখ দুনিয়ার আর কারওর নেই। ভাবলেই চোখ দিয়ে জল নামে আর তাঁর মনটা ভারী হালকা হয়ে যায়! বিয়ে-থা করেননি। থাকার মধ্যে আছেন তিন পিসি। পিসিরাও বিয়ে করেননি, আদরে যত্নে একমাত্র ভাইপোটিকে আগলে রেখেছেন আর তাঁরা গত হলে পুরো সম্পত্তিই পাবেন বিপিনবাবু।
শুধু খটাখটি বাঁধে একজায়গায়। পিসিরা ভালোমন্দ খেতে বড় ভালোবাসেন। ওদিকে যে বিপিনবাবু হোমিওপ্যাথির শিশি করে রান্নার তেল আনেন। রান্নায় দশফোঁটার বেশি তেল দিলেই বিপিনবাবু খাওয়া ফেলে উঠে যান। পিসিরা বন্দোবস্ত করেছেন গ্রামের উঠতি এক চোর চিতেনের সঙ্গে। চিতেন চোর বলে পিসিদের কোনও অসুবিধে নেই। চিতেন তাঁদের ভালোমন্দ বাজার-হাট করে দিয়ে যায়। পিসিরা চুপিচুপি পেট পুরে খেয়ে বাঁচেন। বিনিময়ে চিতেনকে তাঁরা খবর দেন কোন বাড়িতে নতুন বউ এল, পাড়ার কোন গিন্নির নতুন গয়না হল।
একদিন গ্রামে এসে ঢুকল একজন বুড়ো লোক। তার বয়স নাকি দেড়শো ছাড়িয়েছে। দেখে যদিও কিচ্ছু্টি বোঝার উপায় নেই। নাম তার ভজনবাবু। ভজনবাবু গ্রামে ঢুকেই খোঁজ করতে শুরু করলেন, এ গাঁয়ে কিপটে কে আছে। যেমন তেমন কিপটে হলে চলবে না, এক্কেবারে হাড়কেপ্পনটি হতে হবে। একমুহুর্ত দেরি না করে গাঁয়ের লোক দেখিয়ে দিল বিপিনবাবুর বাড়ি।
বিপিনবাবু তো চায়ের খরচার কথা ভেবে ঢুকতেই দিচ্ছিলেন না ভজনবাবুকে। ভজনবাবু নাছোড়বান্দা।
“বিপিনবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, "বেশ করেছি হাড়কেপ্পন হয়েছি। কেপ্পন হয়েছি তো নিজের পয়সায় হয়েছি। আপনার তাতে কী?"
লোকটা মৃদু-মৃদু মাথা নেড়ে বেশ মোলায়েম গলাতেই বলল, "তা অবশ্য ঠিক। তুমি কৃপণ তো তাতে আমার কী যায়-আসে! তবে বাপু, সত্যি কথা যদি শুনতে চাও আমি একজন পাকা কেল্পন লোকই খুঁজে বেড়াচ্ছি। কাউকে তেমন পছন্দ হচ্ছে না। এই তুমি হলে তেরো নম্বর লোক।"
বিপিনবাবু দাঁত কড়মড় করে বললেন, "বটে! তা কেপ্পন দিয়ে কী করবেন শুনি! কেল্পনদের ফলারের নেমন্তন্ন করবেন নাকি?"
হাড়কিপটে মানুষেরা কখনও স্বীকার করে না, তারা কিপটে। বিপিনবাবুও সেই দলেই পড়েন।
“বিপিনবাবু একটু বুক চিতিয়েই বললেন, "শুনুন মশাই, কৃপণ খুঁজতে আপনি খুব ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন। আমি কস্মিনকালেও কৃপণ নই। একটু হিসেবি হতে পারি, কিন্তু কৃপণ কেউ বলতে পারবে না আমাকে। আমি রোজ সকালে মর্তমান কলা খাই, বাজার থেকে ভাল-ভাল জিনিস কিনে আনি, বছরে একজোড়া করে জুতো কিনি, আমার তিনটে ধুতি আর তিনটে জামা, দুটো গেঞ্জি আর একখানা আলোয়ান আছে। কৃপণ হলে হত এত সব? এবার আপনি আসুন গিয়ে। আমার এখন অনেক কাজ।"
লোকটা বাঁদুরে টুপির ফোকর দিয়ে ফোকলা মুখে একটু হেসে বলল, "মর্তমান কলা তো তোমার গাছেই হয়। যেগুলো কাঁদি থেকে খসে পড়ে সেইসব মজা কলা বাজারে বিক্রি হয় না বলে তুমি খাও। বাজারের কথা বললে, শুনে হাসিই পেল। বাজারে তুমি যাও একেবারে শেষে, যখন খদ্দের থাকে না। দোকানিরা যা ফেলেটেলে দেয় তাই তুমি রোজ কুড়িয়ে আনো। জুতো তুমি কেনো বটে, কিন্তু সে তোমার এক বুড়ি পিসি আদর করে তোমাকে কিনে দেয়। তোমার তিনটে জামা আর তিনটে ধুতির কত বয়স জানো? পাক্কা ছ' বছর। আর গেঞ্জি দুটো ঘরমোছার ন্যাতা করলেই ভাল হয়। যাকগে, কৃপণ বলে নিজেকে স্বীকার করতে না চাইলে না করবে। কিন্তু স্বীকার করলে আখেরে লাভই হত। মেলা টাকাপয়সা এসে যেত হাতে।"
‘মেলা টাকাপয়সা’য় দুর্বলতা সব্বার। বিপিনবাবুও রাগ ঝেড়ে নরম হলেন। জানা গেল, ভজনবাবুর গুপ্তধন আছে। ষাটবছর ধরে গুপ্তধন পাহারা দিয়েছেন। এইবার তাঁর দুশ্চিন্তা হচ্ছে, তিনি যদি অক্কা পান তবে গুপ্তধনের কী গতি হবে? গুপ্তধনও যেমন তেমন কিছু নয়। একেবারে সাত সাত ঘড়া মোহর আর সাতঘড়া মণিমুক্তো। স্যাম্পলও এনেছেন ভজনবাবু, একটা ছোট্ট ঝলমলে পাথর আর একটা আকবরি মোহর। দেখেই বিপিনবাবুর লোভী মনটা নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে।
বিপিনবাবু খুবই বিগলিত মুখ করে বললেন, "আশপাশে লোকজন না থাকলে আমি জুতোজোড়া পা থেকে খুলে হাতে ঝুলিয়ে হাঁটি, অন্যদের মতো মাসে-মাসে চুল না ছেঁটে আমি বছরে দু'বার ন্যাড়া হই, দাড়ি কামানোর মেলা খরচ বলে এই দেখুন ইহজন্মে আমি দাড়ি কামাইনি..."
ভজনবাবুকে খুশি করা কঠিন ব্যাপার। এতসব শোনার পরও তিনি অতিশয় জুলজুলে চোখে বিপিনবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, "সবই বুঝলুম, তবে আরও একটু বাজিয়ে দেখতে হবে বাপু। যাকে-তাকে তো আর অত ধনরত্নের দায়িত্ব দেওয়া যায় না।"
বিপিনবাবু হাত কচলাতে-কচলাতে বললেন, “আজ্ঞে, আপনার হল জহুরির চোখ। আশা করি আমাকে চিনতে আপনার ভুল হবে না।"
ভজনবাবু এতক্ষণে গুছিয়ে বসেছেন বিপিনবাবুর বাড়িতে। হুকুম ছুঁড়তে শুরু করলেন একের পর এক।
“ভজনবাবুর ফোকলা মুখে একটু হাসি ফুটল, "এখনও ঠিক-ঠিক চিনেছি বলা যায় না। তবে যেন চেনা-চেনা ঠেকছে। এই যে আমি বুড়োমানুষটা এই বাঘা শীতের সন্ধেবেলা কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির হলুম, তা আমাকে এখন অবধি এক কাপ গরম চা-ও খাওয়াওনি। তুমি পাষণ্ডই বটে।"
বিপিনবাবু শিউরে উঠে বললেন, "চা! ওরে বাবা, সে যে সাঙ্ঘাতিক জিনিস। আগুন, চা-পাতা, চিনি, দুধ, অনেক বায়নাক্কা।"
ভজনবাবু খুব ভালমানুষের মতো মাথা নেড়ে বললেন, "তা তো অতি ঠিক কথাই হে বাপু। তবে কিনা সাত রাজার ধনদৌলত পেতে যাচ্ছ, তার জন্য একটু খরচাপাতি না হয় হলই।"
"তবে কি আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?"
"তা তুমিই বা মন্দ কী?"
"যে আজ্ঞে, তা হলে চায়ের কথাটা মাসিকে বলে আসি।"
"সঙ্গে দুটো বিস্কুট।"
"বিস্কুট!” বলে থমকে দাঁড়াল বিপিনবাবু।
ভজনবাবু ফোকলা হেসে বললেন, "বিস্কুট শুনে মূর্ছা যাওয়ার কিছু নেই। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট আমি পছন্দ করি।"
"যে আজ্ঞে, তা হলে আর কথা কী? বিস্কুট তো বিস্কুটই সই।"
"হ্যাঁ, আর ওইসঙ্গে রাতের খাওয়াটার কথাও বলে এসো। রাতে আমি মাছ-মাংস খাই না। লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ঘন দুধ হলেই চলবে।"
বিপিনবাবু চোখ কপালে তুলে মূর্ছা যাচ্ছিলেন আর কী! নিতান্তই মনের জোরে খাড়া থেকে ভাঙা গলায় বললেন, "ঠিক শুনছি তো! না কি ভুলই শুনলাম।"
"ঠিকই শুনেছ।"
"ওরে বাবা! বুকটা যে ধড়ফড় করছে। হার্টফেল হয়ে মরে না যাই।"
ভজনবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, "তোমার হার্টফেল হলে বিদ্যাধরপুরের পাঁচুগোপাল আছে। তাকে আমার সবদিক দিয়েই পছন্দ ছিল। তোমাকে বাজিয়ে দেখে মনে হয়েছিল, তুমি তার চেয়েও সরেস। কিন্তু বুকের পাটা বলতে তোমার কিচ্ছু নেই।"
বিপিনবাবু সঙ্গে-সঙ্গে বুক চিতিয়ে বললেন, "কে বলল নেই! লুচি, আলুরদম, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ঘন দুধ তো! ওই সঙ্গে আমি আরও দুটো আইটেম যোগ করে দিচ্ছি, পাতিলেবু আর কাঁচালঙ্কা।"
"বাঃ বাঃ, এই তো চাই।"
"আমার হাসিরাশিমাসি রাঁধেও বড় ভাল।"
"আহা, বেশ, বেশ। আর শোনো, বিছানায় নতুন চাদর পেতে দেবে, একখানা ভাল লেপ। আমি আজেবাজে বিছানায় ঘুমোতে পারি না।"
এত পর্যন্ত পড়ে বারবার মনে হচ্ছিল ভজনবাবু একটি ঝানু স্ক্যামবাজ। এমনটি আগের এক অদ্ভুতুড়েতে সত্যিই দেখা গিয়েছে। কিন্তু, না, লেখক গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন এরপরই।
ভজনবাবুকে খুঁজতে দুটো গুন্ডাগোছের লোকের উদয় হল নফরগঞ্জে। একজন গোপাল, অন্যজন গোবিন্দ। ভজনবাবু সত্যিই কিপটে চূড়ামণি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। অন্যগ্রামের একটি ধুরন্ধর কিপটে গুপ্তধনের লোভে ভজনবাবুকে হাতছাড়া করতে চায়নি। সে গুন্ডা পাঠিয়েছিল ভজনবাবুকে কিডন্যাপ করার জন্য।
গোপাল-গোবিন্দর মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন ভালো খেলে না। আছে স্রেফ গায়ের জোরটি। গ্রামের নবীন মুদির কাছে জানতে চাইল ভজনবুড়োর খবর। নবীন মুদি ঝোপ বুঝে কোপ মারতে উৎসুক। দক্ষিণা ছাড়া তার পেট থেকে খবর বেরোবে না।
"একটু তাড়াতাড়ি কষে ভাবো হে। আধ ঘণ্টা পুরতে আর কতক্ষণই বা লাগবে, বড়জোর পাঁচ সাত মিনিট।"
নবীন ফিচিক করে হেসে বলল, "তা মশাই, মাথাটা যে খাটাতে হচ্ছে তারও তো একটা মজুরি আছে না কি?"
"ও বাবা, তুমি যে ধুরন্ধর লোক!"
"যা আকাল পড়েছে। বেঁচেবর্তে থাকতে গেলে ধুরন্ধর না হয়ে উপায় আছে?"
"তা কত চাও?"
"পাঁচটা টাকা ফেললে মনে হয় মাথাটা ডবল বেগে কাজ করবে।"
"রেট বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে হে। দুটো টাকা ঠেকাচ্ছি, ওর মধ্যেই মাথাটা খাটিয়ে দাও ভাই।"
নবীন খবর দিল বটে, তবে আধা খবর ফাঁস করল। ভজনবুড়ো কার বাড়িতে গিয়েছে সেইটি বলার মজুরি চাই আরও দুটো টাকা। এত জুলুম সইল না গোপাল-গোবিন্দর। মুদির ওপর পড়ল ঘা কতক। মার খেয়েও নবীন মুদির ফিচেল বুদ্ধি টসকায়নি। সে গ্রামের এক মুশকো পালোয়ানের বাড়ির ঠিকানায় তাদের পাঠিয়ে দিল।
এইবার আসরে নামে গল্পের ভূত পীতাম্বর। সে ভূত হওয়া ইস্তক কেউ তাকে দেখতে পায় না। তার উপস্থিতি অনুভব করে না। তাই তার ভারী দুঃখ। গোবিন্দ হঠাৎ পেল পীতাম্বরের গায়ের ভূত ভূত গন্ধটা। শুধু গন্ধই নয়, গোবিন্দ শুনতেও পাচ্ছে পীতাম্বরের পিনপিনে মশার গানের মতো গলার আওয়াজখানা। পীতাম্বর খুব খুশি তার ওপর। সে বুঝতে পারছে এদের মতলব খারাপ, তবু তাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত। কারণ? সে যে ‘আছে’, পুরো নেই হয়ে যায়নি এই বিশ্বাসটুকু এনে দিয়েছে গোবিন্দ। মানুষের মতো শীর্ষেন্দুর ভূতেরাও সামান্য একটু ভ্যালিডেশনের জন্য মুখিয়ে থাকে।
পীতাম্বর ভূতের নির্দেশমতো গোপাল গোবিন্দ এসে পৌঁছল বিপিনবাবুর বাড়ি। সেখানে বিপিনবাবুর তিনমাসি তখন একসাথে কান্না জুড়েছেন। কিপটে বিপিনবাবু নাকি ভজনবাবুকে চব্যচোষ্য খাইয়ে তার পা টিপে দিচ্ছেন। মাসিরা নিশ্চিত, ভজনবাবু একটি ছেলেধরা। বিপিনবাবুকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছেন ঝোলায় পুরে। চিতেন চোরের নজর পরল গোপাল গোবিন্দের ওপর। চিতেনের চোস্ত চোখ, এক নজরেই সে বুঝে ফেলল লোকদুটি সুবিধের নয়। আলাপ জমানোর ছলে জেনে নিল এরা কারা কেন এসেছে। বিদ্যাধরপুরের কিপটে পাঁচুগোপালের পাঠানো গুন্ডা এরা। মাত্র একান্ন টাকায় তারা কিডন্যাপিংয়ের কাজ করছে শুনে চিতেন আর হেসে বাঁচে না। ইচ্ছে করেই বাড়িয়ে চাড়িয়ে সে বলতে লাগল ভজনবাবুর গুপ্তধনের খবর।
চিতেন একটু হেসে বলল, "সেবার কথা আর বলবেন না মশাই। সেবা নিতে নিতে ভজনবাবুর এখন অরুচি। বললে বিশ্বাস করবেন না, তিনি তো সোনাদানা আগলে গহিন জঙ্গলের মধ্যে বাস করেন। জনমনিষ্যি নেই। তা সেখানেও কী হয় জানেন? দু' বেলা দুটো কেঁদো বাঘ এসে রোজ তাঁর পিঠ চুলকে দেয়। ঘুমনোর সময় দুটো গোখরো সাপ এসে তাঁর দু' কানে লেজ ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম পাড়ায়। এই শীতকালে রাতের দিকে যখন হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়ে তখন হলধর আর জলধর নামে দুটো ভালুক এসে দু'ধার দিয়ে ভজনবাবুকে জড়িয়ে ধরে ওম দেয়। গদাধর নামে একটা কেঁদো হনুমান রোজ তাঁর জন্য গাছ থেকে ফলটল পেড়ে আনে। কামধেনু নামের একটা গোরু এসে দু'বেলা দু' ঘটি করে দুধ দিয়ে যায়..."
গোপাল আর গোবিন্দর চোখ ক্রমে ছানাবড়া হচ্ছিল। গোপাল বলল, "বলেন কী মশাই!"
চিতেন একটু ফিচকে হেসে বলে, "ঠিকই বলছি। যাঁর অত সোনাদানা আছে তাঁকে কে না খ্যাতির করে বলুন। তবে ভজনবাবুর তো দিন ফুরিয়ে এল। শুনছি তিনি বিপিনবাবুকে সব দিয়েথুয়ে সন্নিসি হয়ে হিমালয়ে চলে যাবেন।"
গোপাল শশব্যস্তে বলল, "আচ্ছা না-হয় ভজনবাবুর পা না-ই টিপলুম, বিপিনবাবুর পদসেবা করারও কি সুযোগ হবে না মশাই?"
চিতেন দুঃখের সঙ্গে বলে, "বিপিনদাদার তো দুটো বই ঠ্যাং নেই। তা সে দুটোর জন্যও মেলা উমেদার। আমার খাতায় ইতিমধ্যেই বিশ-পঁচিশজনের নাম উঠে গেছে। মাথাপিছু কুড়ি টাকা রেট।"
গোপাল গোবিন্দকে ধমকে উঠে বলল, "হাঁ করে দেখছিস কী? দে টাকাটা গেঁজে থেকে বের করে।"
মাঝরাতে ভজনবাবু বিপিনবাবুকে নিয়ে উধাও হলেন দুটো গ্রাম পেরিয়ে মধুবনির জঙ্গলের দিকে। তক্কে তক্কে ছিল চিতেন। সেও পিছু নিল। পীতাম্বর ভূতও গোপাল-গোবিন্দকে ঠেলেগুঁজে নিয়ে এল জঙ্গলে।
মধুবনির জঙ্গলে পোড়ো বাড়ি। বাড়ির পাশে অদ্ভুত দেখতে গাছ। সেখানে আছে এক কথাবলা টিয়াপাখি, তার ঠোঁটের নীচে কালো দাড়ি, মাথায় কালো চুল। গাছের ডালে হনুমান, সেও বেশ টকর টকর কথা বলে। তার দেড়হাত লম্বা দাড়ি, মাথায় বাবরি চুল। চুলদাড়িওয়ালা কথাবলা একজন খরগোশও আছে। সব মিলিয়ে ভারী অদ্ভুতুড়ে এক পরিবেশ।
পোড়ো বাড়ির ভেতরে আছে সত্যি সত্যিই সাত কলসি মোহর আর সাত কলসি মণিমুক্তো। সেসব দেখে বিপিনবাবু তো খুশিতে ডগমগ। সবই নাকি এখন বিপিনবাবুর। তবে শর্ত একটাই, বিপিনবাবুকে এখানেই থাকতে হবে আর এইসব জিনিস ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া চলবে না। তবু বিপিনবাবু একটিবার রোদের আলোয় ওগুলো দেখতে চাইলেন। এইবারেই গল্পের আসল চমক। বাইরে আনতেই দেখা গেল, মোহরের বদলে ওগুলো সব সিসে আর মণিমুক্তোগুলো স্রেফ পাথরকুচি। ঘরের ভেতরে নিলে আবার যেই কে সেই, হিরের জলুস আর সোনার ঝকমকি।
ভজনবাবু বললেন "তুমি হলে কৃপণ লোক, এসব তো প্রাণে ধরে খরচ করবে না কখনও, সুতরাং ওপরে আনারও দরকার নেই। নীচের ঘরে নিয়ে গেলেই দেখবে, ওই সিসেগুলো ফের খাঁটি মোহর হয়ে গেছে, পাথরগুলো হয়ে গেছে হিরে। এখন থেকে তুমি নীচের ঘরে বাস করলেই তো হয়।"
এসে পড়ল গোপাল গোবিন্দও। গুপ্তধন দেখার উৎসাহটা থিতিয়ে এলে তারাও বুঝতে পারল গড়বড়টা কোথায়। সত্যিই তো! যে কিপটে, তার কাছে সোনাদানাও যা, পাথরের টুকরোও তা। বিপিনবাবু ভালো খান না, ভালো পরেন না। তাঁর জমানো টাকা কোনও কাজেই লাগে না। সেসব জমানো টাকা যদি স্রেফ বাজে কাগজের নোট হয়ে যায়, তাতেও তাঁর কিচ্ছুটি যাবে আসবে না। মনে পড়ে সেই প্রথম অদ্ভুতুড়ে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’? রাজার জমানো টাকাগুলো কবেই তামাদি হয়ে গিয়েছিল, রাজা তার খবরও রাখতেন না। স্রেফ টাকা গুণেই তাঁর সুখ ছিল। বিপিনবাবুও সেই পথেই এগোচ্ছিলেন।
বিপিনবাবু, চিতেন চোর, গোপাল, গোবিন্দ কেউ রাজি হল না জঙ্গলে পড়ে থেকে পাথরকুচি আর সিসে পাহারা দিতে। তারপর? ভজনবাবুর করুণ হাসি হেসে চলে যাবার জন্য তৈরি হলেন। পোড়ো বাড়ির পাশের সেই অদ্ভুত গাছটাই তাঁর স্পেসশিপ। জঙ্গলের সব অদ্ভুতুড়ে জানোয়ারগুলো একে একে উঠে পড়ল স্পেসশিপে। ভজনবাবুও স্পেসশিপে উঠলেন। তারপর সোঁ সোঁ করে আকাশে উঠে তারা মিলিয়ে গেল।
আর..
“গোপাল চোখের জল মুছে বলল, "গোবিন্দ, আর নয় রে, আর গণ্ডগোলের জীবনে যাব না।"
"যা বলেছ গোপালদা।"
বিপিনবাবু চোখের জল মুছে বললেন, "এবার থেকে রোজ গাওয়া ঘিয়ের লুচি খাব রে চিতেন।"
"হ্যাঁ। আর আমাকেও চুরি ছেড়ে অন্য লাইন ধরতে হবে।"
গল্প এখানেই শেষ। তবে ভজনবাবু কোন গ্রহের লোক, কেন এসেছিলেন আর সেই অদ্ভুতুড়ে জানোয়ারগুলোই বা কারা তা লেখক খোলসা করে বলেননি। পাঠকের জন্য ইচ্ছেমতো কিছু একটা ভেবে নেবার অঢেল সুযোগ দিয়ে দিয়েছেন।
শুধু একটা হিসেব মিলল না। স্যাম্পল হিসেবে যে মোহর আর হিরে বিপিনবাবুর বাড়ি এনেছিলেন ভজনবাবু, সেই দুটো জিনিস কি আসল ছিল? পোড়ো বাড়ি থেকে বের করলেই তো মোহর আর হিরেগুলো সব পাথরকুচি হয়ে যায়। তাহলে স্যাম্পলদু্টো কীভাবে ঠিক থাকল?
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৬ - ছায়াময় - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৭ - সোনার মেডেল - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৮ - নবীগঞ্জের দৈত্য - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৯ - কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২০ - অদ্ভুতুড়ে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২১ - পাতালঘর -আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২২ - হরিপুরের হরেক কাণ্ড -আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৩ - দুধসায়রের দ্বীপ - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২৪ - বিপিনবাবুর বিপদ - আলোচনার লিংক