জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - নবম পর্ব

প্রথম পর্বের লিংক

দ্বিতীয় পর্বের লিংক

তৃতীয় পর্বের লিংক

চতুর্থ পর্বের লিংক

পঞ্চম পর্বের লিংক 

ষষ্ঠ পর্বের লিংক

সপ্তম পর্বের লিংক

অষ্টম পর্বের লিংক

নবম পর্ব 

মিস্টার রাশওয়ার্থ দরজার কাছেই অপেক্ষা করছিলেন তাঁর প্রিয়াকে স্বাগত জানানোর জন্য। শুধু মারিয়াকেই নয়, তিনি দলের সবাইকেই যথাযথ মর্যাদায় অভ্যর্থনা জানালেন। এরপর বসার ঘরে পৌঁছলে সেখানে তাঁর মাও সমান আন্তরিকতার সঙ্গে সবাইকে আপ্যায়ন করলেন। মারিয়া যতোটা আশা করেছিল, ঠিক ততোটা গুরুত্বই পেল সবার কাছে।

আগমনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রথম কাজ ছিল খাওয়া। দু একটা ঘর পরে খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো সবাইকে। সেখানে হালকাফুলকা অনেক খাবার খুব সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন করে রাখা। অনেক গল্প করতে করতে, অনেক কিছু খেতে খেতে সব কিছু খুব ভালো ভাবেই মিটল।

এবার যে উদ্দেশ্যে সবার যাওয়া, সেই বিষয়ে আলোচনা শুরু হলো। যদি মিস্টার ক্রফোর্ড পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে চায় তাহলে কেমন করে দেখা হবে? মিস্টার রাশওয়ার্থ তাঁর দুই ঘোড়ায় টানা ছোট খোলা গাড়িটা (কারিকল) নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। তবে মিস্টার ক্রফোর্ড অন্য কথা বলল। “আরও কয়েকজন সঙ্গে গেলে তারা কেমন দেখছে, কী ভাবছে, এগুলো জানা যাবে। আর সেটা পাওয়ার সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করার মতন বড় ক্ষতি আর কিছু হয় না। সেই বঞ্ছনা কিন্তু আপাতত যে আনন্দ আমরা পাচ্ছি, তার থেকেও বেশি।“

সেই শুনে মিসেস রাশওয়ার্থ প্রস্তাব দিলেন তাহলে অন্য বড় ঢাকা গাড়িটাও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হোক। কিন্তু এই প্রস্তাবে কেউই বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। মেয়েরা কেউ কিছু না বললেও মুখে হাসি ফুটল না ওদের। তাই দেখে মিসেস রাশওয়ার্থ এবার প্রস্তাব দিলেন যে তাহলে যারা এই বাড়িতে আগে আসে নি, তাদের ঘুরিয়ে দেখানো হোক বাড়িটা। এই প্রস্তাবে সবাই বেশ উৎসাহিত বোধ করল। মারিয়া খুশি হলো এই ভেবে যে বাড়িটা যে কতটা বড়, সেটা সবাইকে দেখাতে পারবে, আর বাকিরা এই ভেবে খুশি হয়ে উঠল যে তারা সবাই মিলে কিছু একটা করার সুযোগ পাবে।

সেই মতন সবাই মিলে উঠে পড়ল। এরকম বাড়িতে সাধারণত বাড়ির পরিচারিকাই বাড়ি ঘুরিয়ে দেখায়। কিন্তু মিসেস রাশওয়ার্থ বাড়ির পরিচারিকার কাছ থেকে সব ইতিহাস যত্ন করে শিখেছেন, এবং আজ তাঁর বিশেষ অতিথিদের সবাইকে নিজেই বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। অনেক উঁচু ছাদ, বিশাল বিশাল অনেক ঘর। খুব সুন্দর করে সাজানো। চকচকে মেঝে, শক্ত মেহগনি কাঠের আসবাবপত্র, দামি পর্দা, সোনালি কারুকাজ করা মার্বেলের পিলান। সবই খুব সুন্দর, তবে সবই আজকের নয়, পঞ্চাশ বছর আগের রুচি অনুযায়ী সাজানো। অনেক ছবিও আছে। সেসব ছবির মধ্যে মাত্র অল্প কিছু ছবিই ভালো ছবি, বেশিরভাগই পারিবারিক ছবি। তাই মিসেস রাশওয়ার্থ ছাড়া আর কারোর কাছেই সেই সব ছবির কোনও আবেদন নেই।

এখন তিনি বাড়িটা দেখানোর সময় প্রধানত মিস ক্রফোর্ড এবং ফ্যানিকে লক্ষ্য করে কথা বলছেন। তবে ওরা দুজন যেভাবে সবকিছু শুনছে বা দেখছে তাতে কিন্তু আকাশ পাতাল তফাৎ। মিস ক্রফোর্ড, এরকম বড় বড় সাজানো গোছানো বাড়ি আগেও অনেক দেখেছে আর সেসবের কোনোটাই ওর খুব একটা ভালো লাগেনি। তাই এখন সে কেবল ভদ্রতার খাতিরেই মিসেস রাশওয়ার্থের কথা শুনছে। এদিকে যেহেতু ফ্যানির কাছে সব কিছুই নতুন, তাই সবকিছুই ওর কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় বলে মনে হচ্ছে। যতটুকু ইতিহাস ফ্যানির জানা আছে, তার সঙ্গে মিসেস রাশওয়ার্থের বলা তাঁর পরিবারের অতীত ইতিহাস, তাঁদের উত্থান, গৌরব, রাজপরিবারের আগমন আর তাঁদের প্রতি আনুগত্যের গল্প সব কিছুই সে যেন মিলিয়ে নিচ্ছে। একই সঙ্গে যা জানা নেই, সেসব গল্প ফ্যানির পুরনো দিনের কল্পনায় ছবির মতন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

বাড়িটা এমন জায়গায় অবস্থিত যে কোনও ঘর থেকেই বাইরের দিকটা খুব ভালো করে দেখা যায় না। একদিকে ফ্যানি ও অন্য সবাই মিসেস রাশওয়ার্থের কথা শুনছে। অন্যদিকে হেনরি ক্রফোর্ড ক্রমাগত জানালাগুলোর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ছে। বাড়ির পশ্চিম দিকের ঘরগুলো থেকে বাইরের দিকে তাকালে দেখা যায় এক সবুজ লন, তার পরে লোহার উঁচু প্রাচীর। আর তারও পরে গেট পেরিয়ে শুরু হচ্ছে দুপাশে গাছ দিয়ে মোড়ানো অ্যাভিনিউ।

অনেকগুলো ঘর ঘুরে দেখে মনে হলো সেগুলোর যেন কোনো প্রয়োজনই নেই। যে বাড়িতে যত বেশি জানলা থাকে সেই বাড়ির মালিককে ততো বেশি কর দিতে হয়। দেখে মনে হচ্ছে যেন শুধুমাত্র ওই কর দেওয়ার জন্য বা গৃহপরিচারিকাদের কাজ জোগানোর জন্যই বানানো হয়েছে ঘরগুলো। এরপর মিসেস রাশওয়ার্থ বললেন, “এবার আমরা বাড়ির গির্জায় (চ্যাপেল) ঢুকব। এমনিতে আমাদের ওপর থেকে ঢোকা উচিত, যাতে নিচটা উপর থেকে ভালো করে দেখা যায়। কিন্তু যেহেতু আমরা সবাই নিজেদেরই লোক, তাই যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি আপনাদের এই দিক দিয়েই নিয়ে যাব।”

সবাই ভিতরে ঢুকল। ভিতরে একটা লম্বাটে বড় ঘর, প্রার্থনার জন্য সাজানো। উপরে যেখানে পরিবারের সবাই প্রার্থনা করে সেই পারিবারিক গ্যালারির কিনারায় অনেকগুলো মেগগনি কাঠের আসবাবপত্র আর টুকটুকে লাল বালিশ ছাড়া সেরকম নজরকাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। ফ্যানি ভেবেছিল দারুণ জমকালো একটা গির্জা দেখবে। এখন এই সাধারণ চেহারার গির্জা দেখে সে নিচু গলায় এডমন্ডকে বলল, “যাহ্‌, এটা কেমন হলো! কোনো চ্যাপেল কেমন হতে পারে বলে আমি যেরকম ভাবতাম, এটা তো একেবারেই সেরকম নয়। দারুণ অবাক হওয়ার মতন, বিষণ্ণ হওয়ার মতন, বা রাজকীয় কিছুই নেই দেখছি। না আছে কোনও খিলান, গম্বুজ, শিলালিপি বা পতাকা। মানে, রাতের বাতাসে উড়বে এরকম কোনও পতাকা নেই! এমন কী এরকম কিছুও লেখা নেই, “এখানে স্কটিশ রাজার শব ঘুমিয়ে আছে!”

“ফ্যানি, তুমি এটা ভুলে যাচ্ছ যে এই চ্যাপেলটা খুব একটা পুরনো নয়। আর এটাও ভুলে যাচ্ছ যে এই চ্যপেলটা আগেকার কোনও দুর্গ বা ধর্মস্থানের জন্য বানানো হয় নি। এটা নিছক পারিবারিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই বানানো। আমার মনে হয় এই পরিবারের মৃত ব্যক্তিদের মৃতদেহ এই এলাকার যে গির্জা আছে, সেখানেই কবর দেওয়া হয়। ওসব পতাকা বা অন্যান্য প্রতীক দেখতে চাইলে তোমাকে সেখানে যেতে হবে।“

“ও, তাও তো ঠিক। এভাবে না ভাবাটা আমার ভারী বোকামি হয়েছে। কিন্তু তাও বলব, আমি এই চ্যাপেল দেখে হতাশ।“

মিসেস রাশওয়ার্থ বলা শুরু করলেন, “এই চ্যাপেলটা দ্বিতীয় জেমসের সময় যেমনটা সাজানো হয়েছিল, এখনও ঠিক সেরকমই দেখছ তোমরা। তার আগে, যতদূর জানি, বসার জায়গাগুলো সাধারণ ওক কাঠ দিয়ে তৈরি ছিল। সেগুলো আর পারিবারিক আসনের ঢাকা আর কুশনগুলো শুধু বেগুনি কাপড়ে মোড়া ছিল। অবশ্য এই ব্যাপারে যে আমি একেবারে নিশ্চিত, তা না। তবে এই চ্যাপেলটা সত্যিই বেশ সুন্দর। আগে সকালে ও সন্ধ্যায় এখানে নিয়মিত প্রার্থনা হতো। এখনো অনেকের মনে আছে যে এই বাড়ির নিজস্ব যাজক সেই প্রার্থনা করাতেন। তবে আমার স্বামী স্বর্গীয় মিস্টার রাশওয়ার্থ সেটা বন্ধ করে দেন।”

“প্রতিটি প্রজন্ম একটু একটু করে বদলে যায়,” এডমন্ডকে উদ্দেশ করে মৃদু হেসে বলল মিস ক্রফোর্ড।

মিসেস রাশওয়ার্থ এতক্ষণ যা যা বললেল, আবার সেসব কথা মিস্টার ক্রফোর্ডকে বলতে গেলেন। ফ্যানি, এডমন্ড আর মিস ক্রফোর্ড তখন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রইল।

ফ্যানি বলে উঠল, “ইশ, পারিবারিক যাজক দিয়ে প্রার্থনার আগেকার সেই রীতি যে এখন আর নেই, এটা জেনে আমার বেশ খারাপ লাগছে। আগেকার দিনের ওই নিয়মটা খুব ভালো ছিল। খুবই মূল্যবান। এমন একটা বড় বাড়ি, তার নিজস্ব চ্যাপেল আর যাজক — সব মিলিয়ে এক অসাধারণ পরিবেশ তৈরি করে। পুরো পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে প্রার্থনায় অংশ নেওয়া — এককথায় সত্যিই অনবদ্য!”

“সত্যিই ব্যাপারটা খুব অনবদ্য! নিজেরা নানান অজুহাতে না এসে, বেচারা গৃহপরিচারক আর চাকর-বাকরদের সব কাজ ও আনন্দ ফেলে রেখে দিনে দুবার এখানে প্রার্থনা করতে আসায় বাধ্য করে, বাড়ির কর্তা ও কর্ত্রীর তাতে খুব উপকার হতো নিশ্চয়ই!” হেসে বলল মিস ক্রফোর্ড।

“আরে না, না, পারিবারিক জমায়েত বলতে ফ্যানি এরকম কিছু মোটেই ভাবছে না। বাড়ির কর্তা, কর্ত্রী নিজেরাই না থাকলে পারিবারিক জমায়েতের এরকম রীতি থাকার থেকে না থাকাই ভালো।“ এডমন্ড বলল।

“সে যাই হোক, আমার মনে হয়, এসব বিষয়ে মানুষকে নিজের মতো থাকতে দেওয়াই ভালো। প্রার্থনা করার জন্য সবাই নিজের মতো সময় আর উপায় বেছে নিতে চায়। বাধ্যবাধকতা, আনুষ্ঠানিকতা, সময়ের দৈর্ঘ্য — সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কিন্তু বেশ মুস্কিলের। কেউই এটা পছন্দ করে না। যারা আগে ওই গ্যালারিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে হাই তুলত, তারা যদি জানত যে একদিন এমন সময় আসবে — যেদিন মাথাব্যথা করলে আরও দশ মিনিট বিছানায় শুয়ে থাকতে পারবে, চ্যাপেলের প্রার্থনায় অংশগ্রহণ না করলেও কেউ কিছু বলবে না — তাহলে তারা একই সঙ্গে আনন্দে আর ঈর্ষায় লাফিয়ে উঠত। তুমি কি কল্পনা করতে পারছ না, যে আগে এই রাশওয়ার্থ পরিবারের কম বয়সী মেয়েরা কতটা অনিচ্ছায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে এই চ্যাপেলে হাজিরা দিতে আসত? ভাবতে পারছ আগেকার দিনের অল্প বয়সী মেয়েরা সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে এখানে আসছে, ওদের দেখলে আপাত দৃষ্টিতে হয়তো খুব ধার্মিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু মাথায় হয়তো তাদের অন্যকিছু ঘুরছে। বিশেষ করে বেচারা যাজককেও যদি তাকিয়ে দেখার মতন না হয়। মানে, আগেকার দিনে এই যাজকরা এখনকার যাজকদের মতন এতটা ভালো হতোনা বলেই তো আমার মনে হয়।“

কিছুক্ষণের জন্য কেউই ওর কথার কোনও উত্তর দিলো না। অপ্রস্তুত ফ্যানি এডমন্ডের দিকে তাকাল। কিন্তু এই মুহূর্তে ও এতোটাই রেগে গিয়েছে যে কিছুই বলতে পারল না। অন্যদিকে এডমন্ড একটু সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে উত্তর দিলো, “আসলে কী বলো তো, তোমার হালকা আর ছটফটে মন ধর্মের মতন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও যেন ঠিক গভীর হতে পারে না। তুমি আমাদের কাছে যে অদ্ভুত মজার দৃশ্যটা বর্ণনা করলে সেটা যে ঠিক নয়, সেকথা কেউ বলতে পারবে না। তবে, অনেকসময় নিজের মন মতন চিন্তাভাবনা সাজানো বেশ কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে ওঠে। কিন্তু তুমি যদি সেটাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নাও, মানে, না জানার ফলে যে দুর্বলতা তৈরি হয় সেটাই যদি তোমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়, এরকম মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা থেকে আর কীই বা আশা কর যায়! তোমার কি মনে হয় যে যারা কষ্ট পায়, যারা চার্চে প্রার্থনা করতে আসে, তারা নিজের মতো করে একা একা আরও ভালোভাবে প্রার্থনা করতে পারবে?”

“হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়। সেক্ষেত্রে তাদের কাছে অন্তত দুটো সুবিধা থাকবে। ওদের মনটা অন্যদিকে যাওয়ার সুযোগ কম থাকবে আর অনেকবেশি সময় নিয়ে তাদের চেষ্টা করতে হবে না।“

“আমার মনে হয়, যে মানুষকে কোনও একটা পরিস্থিতিতে নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় না, সেই মানুষটাই হয়তো অন্য একটা পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কোনও একটা জায়গার প্রভাব বা সেখানে উপস্থিত অন্য মানুষদের দেখে প্রথম থেকেই একটা ভালো অনুভূতি জেগে ওঠে। অবশ্য এটা আমি স্বীকার করি যে অনেকক্ষণ ধরে প্রার্থনা চললে সেটা কারোর কারোর জন্য বেশ ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। কারোর এটা মনে হতেই পারে যে এতক্ষণ ধরে প্রার্থনা না চললেই ভালো হতো, কিন্তু অক্সফোর্ডের চ্যাপেলে কেমন প্রার্থনা হতো সেটা আমি এখনও ভুলি নি।“

ওদের মধ্যে যখন এইসব আলোচনা চলছে, তখন বাকি লোকজন সবাই চ্যাপেলের এদিকওদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। এমন সময় জুলিয়া মিস্টার ক্রফোর্ডকে ডাকল। “দেখো একবার, মিস্টার রাশওয়ার্থ আর মারিয়া কেমন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে! ঠিক যেন মনে হচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠানে যেভাবে দাঁড়াবে, সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। কি, ওদের দেখে ঠিক সেরকমই মনে হচ্ছে না?”

কথাটা শুনে মিস্টার ক্রফোর্ড একটা অনিচ্ছুক হাসি হেসে মারিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর নিচু গলায় বলল, “মিস বার্ট্রামকে বেদির এতো কাছাকাছি দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না আমার।“ কথাটা ও এতোটাই নিচু গলায় বলল, যাতে মারিয়া ছাড়া আর কারোর কানে যেন না যায়।

কথাটা শুনে একটু চমকে গিয়ে দু-এক পা এগিয়ে এসেও মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল মারিয়া। তারপর একটু হেসে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করল, “যদি আমাকেই ঈশ্বরের কাছে দান করে দেয়?”  

“জানি না সেক্ষেত্রে আমি কী করব!” অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিল হেনরি।

“ইশ, বিয়েটা যদি এখনই হয়ে যেত, তাহলে কী ভালোই না হতো! আমার কথা যদি বলি, তাহলে বলি, আমার তো মনে হচ্ছে এখন এখানে বিয়ে দেওয়ার জন্য একজন ঠিকঠাক লাইসেন্সধারী কেউ থাকলে বিয়েটা এখনই হয়ে যেতে পারত। এখানে আমরা সবাই আছি। তাই এখনই বিয়েটা হয়ে গেলে তার থেকে ভালো আর কিছুই হতো না।“ কোনোদিকে খেয়াল না করে জুলিয়া এমন করে হেসে হেসে কথাটা বলল যে মিস্টার রাশওয়ার্থ আর তাঁর মা’ও ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন। ফলে মারিয়া ফিসফিস করে তার প্রেমিকের সঙ্গে যে রসিকতা করেছে সেটাও প্রকাশ্যে চলে এলো। তবে মিস্টার রাশওয়ার্থ যথাযথ সৌজন্যময় হাসি আর মর্যাদাপূর্ণ ভঙ্গিতে বলে উঠলেন যে বিয়েটা যখনই হোক না কেন, সেটা তাঁর জীবনের সবথেকে আনন্দের ঘটনা হবে।

“ইশ, এডমন্ড যদি বিয়ে দিতে পারত!” কথাটা বলেই দৌড়ে এডমন্ডের কাছে গিয়ে হইহই করে উঠল জুলিয়া, “এডমন্ড, যদি ইতিমধ্যে তুমি পাদ্রি হয়ে যেতে আর তোমার যদি বিয়ে দেওয়ার লাইসেন্স থাকত, তাহলে এখনই তুমি মিস্টার রাশওয়ার্থ আর মারিয়ার বিয়েটা দিয়ে দিতে পারতে। আমাদের কপাল খারাপ, যে তুমি এখনও বিয়ে দিতে পারো না। ওরা দুজন বিয়ে করার জন্য এক্কেবারে তৈরি।“

জুলিয়া যখন এ কথা বলছে, তখন মিস ক্রফোর্ডের মুখভঙ্গি দেখলে একজন উদাসীন দর্শকও হয়তো হেসে ফেলবে। ও এই মুহূর্তে যা শুনছে, তাতে যে ও ভারী চমকে উঠেছে তা ওকে দেখেই বোঝা যায়। ওর অবস্থা দেখে ফ্যানির একটু মায়াই হলো। একটু আগে যে ও কী বলেছে সেটা ভেবে মেরি এখন কতটা অস্বস্তিতে পড়বে, ফ্যানি সেটাই ভাবছে।

“তুমি! যদি পাদ্রি হতে! মানে? তুমি কি পাদ্রি হবে নাকি?” মিস ক্রফোর্ড জানতে চাইল।

“হ্যাঁ, আমার বাবা ফিরে এলেই আমি পাদ্রি হয়ে যাব। হয়তো এবারের বড়দিনের সময়ই।“

খুব দ্রুত নিজের অস্বস্তি আর অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে উঠে মিস ক্রফোর্ড বলল, “এবাবা, আগে জানলে আমি এরকম করে কথা বলতাম না। পাদ্রিদের প্রতি আরেকটু সম্মান দিয়ে কথা বলতাম।“ কথাটা বলেই ও তারপর অন্য প্রসঙ্গ চলে গেল।

তারপর সারা বছর যেরকম শান্তি বিরাজ করে, আবার সেরকম শান্তি আর স্থিরতার আবহ ফিরে এল চ্যাপেলে। বোনের উপর অসন্তুষ্ট মারিয়া সবার আগে চ্যাপেল ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে সবারই মনে হলো অনেকক্ষণ চ্যাপেলে থাকা হয়েছ, আর মারিয়ার পিছন পিছন বেরিয়ে এল।

বাড়ির নিচের তলাটা ভালো করে দেখানো হয়েছে। তাই মিসেস রাশওয়ার্থ এবার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য উপরের তলাটা সবাইকে ঘুরিয়ে দেখানো। এই বাড়ি দেখানোর ব্যাপারে তিনি কখনই ক্লান্ত হন না। কিন্তু তাঁর ছেলে এবার বাদ সাধলেন। সময় বেশি নেই। তিনি বললেন, এতক্ষণ ধরে বাড়ি দেখলে বাইরে ঘোরার সময় থাকবে না। যে কাজের জন্য সবাই এসেছে সেটাই হবে না। এখনই দুপুর দুটো বেজে গিয়েছে, এরপর পাঁচটার সময় আবার রাতের খাবার খাওয়ার সময়। কথাটা এতোটাই সত্যি যে যেকোনোও স্বাভাবিক বুদ্ধির মানুষ এটাকে অস্বীকার করতে পারবে না।

মিসেস রাশওয়ার্থও বাড়ি দেখানো ছেড়ে দিলেন। এবার বাইরের অংশটা কে, কার সঙ্গে, কীভাবে দেখতে যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। কোন কোন গাড়ি আর ঘোড়া নিয়ে এই পরিদর্শনে যাওয়া যায়, সেই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেন মিসেস নরিস। এরপর বাইরের মাঠ আর গাছপালার কাছে যাওয়া যাবে এরকম একটা দরজার সামনে এসে উপস্থিত হতেই অল্প বয়সী সবাই মুহূর্তের মধ্যে হুরমুরিয়ে বেরিয়ে গেল।  

অবস্থা বুঝে মিসেস রাশওয়ার্থ বললেন, “আপাতত সবাই তাহলে কিছুক্ষণের জন্য এখানেই থাকি বরং। এই যে এখানে আমাদের সবথেকে সুন্দর গাছগুলো আছে। আর এই যে, এখানে কিছু পাখি আছে।“

মিস্টার ক্রফোর্ড চারদিকে ঘুরে দেখে বললেন, “অন্য কোথাও যাওয়ার আগে এখানে আমাদের কিছু করার না থাকলেও এখানে যে দেওয়ালটা দেখতে পাচ্ছি, আমার মনে হয় এটার বিষয়ে কিছু করা যেতেই পারে। মিস্টার রাশওয়ার্থ, আমরা তো এখানেই আমাদের আলোচনাটা করতে পারি?”

মিসেস রাশওয়ার্থ তাঁর ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “জেমস, আমার মনে হয় এখানে এই বুনো পরিবেশ সবার জন্যই একবারে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হবে। দুই বার্ট্রাম বোনের কেউই তো এরকম জঙ্গল দেখে নি এখনও।“

কেউই কোনও আপত্তি করল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, নতুন কিছু করার ব্যাপারে বা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখার ব্যাপারে করোরই কোনও উদ্যোগ নেই। সবাই নিজের মতন ঘোরাঘুরি করতে লেগেছে আর গাছপালা, পাখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একটা সময় মিস্টার ক্রফোর্ড বাড়ির শেষের দিকটা দেখতে এগিয়ে গেলেন। বাড়ির লনের দুই পাশে উঁচু পাঁচিল। প্রথম বাগানটা পেরিয়ে একটা সুন্দর করে ঘাস কেটে বোলিং খেলার জায়গা করে রাখা। সেই খেলার জায়গা পেরিয়ে বসার জন্য একটা লম্বা জায়গা। রাস্তাটার পিছন দিকটা লোহার বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। এখান থেকে আশেপাশের গাছপালা দেখা যাচ্ছে। জায়গাটা বসে বসে গল্পগুজব বা পরনিন্দা পরচর্চা করার জন্য একেবারে আদর্শ। মিস্টার ক্রফোর্ডের পিছন পিছন মারিয়া আর মিস্টার রাশওয়ার্থ এগিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর যখন অন্যরা নিজেদের মতন দল বাঁধতে শুরু করল তখন দেখা গেল এডমন্ড, মিস ক্রফোর্ড ও ফ্যানি, এই তিনজন মিলে সেই বসার জায়গায় নিজেদের মধ্যে নানান আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। দলের অন্যান্যরা এই তিনজনের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য বিভিন্ন ঝুট ঝামেলার আলোচনায় অংশ নিয়ে আবার এগিয়ে গেল। বাকি তিনজন, মিসেস রাশওয়ার্থ, মিসেস নরিস, ও জুলিয়া, এখন বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এখানে আসার সময় জুলিয়ার কপালটা যতোটা ভালো বলে মনে হয়েছিল, এখন আর তা মনে হচ্ছে না। মিসেস রাশওয়ার্থ আস্তে আস্তে হাঁটছেন আর জুলিয়া এখন কিছুটা বাধ্য হয়েই নিজের তাড়াতাড়ি হাঁটার অধৈর্য ইচ্ছেকে দমন করে মিসেস রাশওয়ার্থের পাশাপাশি হাঁটছে। এদিকে মিসেস নরিস এই বাড়ির কাজের লোকটাকে পাকড়াও করেছেন। কাজের লোকটা পাখির খাবার দেওয়ার জন্য বাইরে এসেছিল। মিসেস নরিস তাকে পাকড়াও করে বিভিন্ন গুজব আলোচনা করতে করতে সবার একদম পিছন পিছন আসছেন। 

বেচারা জুলিয়া! ওদের ন’জনের দলের মধ্যে একমাত্র ওই আপাতত খুব একটা খুশি নয়। এমনকি বেশ মন খারাপও হচ্ছে ওর। সকালে এখানে আসার সময় বারুচ গাড়ির সামনে বসে আসার সময় ওর মেজাজটা যতোটা হাসিখুশি ছিল, এখন সেই মেজাজের ছিটেফোঁটাও নেই ওর মধ্যে। সকলের প্রতি শিষ্টাচারের যে অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে ও বড় হয়েছে, সেই শিষ্টাচারের শিক্ষা এখন ওকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে। আবার একই সঙ্গে, আত্মসংযম, অন্যের প্রতি সহানুভুতি, নিজের সঙ্গে গভীর বোঝাপড়া, ঠিক ভুলের বিচার – এই সব মানবিক গুণ ওর শিক্ষা আর বড় হয়ে ওঠার অংশ ছিল না কখনই। আর এখন এগুলোর অভাবই ওকে অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে। 

বসার জায়গাটায় এক চক্কর ঘুরে আরেক চক্কর দিতে দিতে যে দরজাটা দিয়ে গেলে ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে যাওয়া যাবে তার সামনে দাঁড়িয়ে মিস ক্রফোর্ড বলল, “উফ, কী অসহ্য গরম! একটু ঠাণ্ডা জায়গায় যেতে কারোর আপত্তি আছে কি? এই তো, সামনেই একটা ছোট্ট সুন্দর জঙ্গল। ওখানে কোনক্রমে ঢুকতে পারলে খুব ভালো হতো। যদি এই দরজাটা তালা বন্ধ না থাকে, তাহলে তার থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে। কিন্তু, যা কপাল আমাদের! দরজাটা নির্ঘাত তালা মারা। এরকম বড়সড় জায়গায় যে কেউ তো যেখানে সেখানে যেতে পারে না, একমাত্র বাগানের মালীই যেখানে খুশি যেতে পারে।“

কিন্তু ঘটনাচক্রে দেখা গেল দরজাটা তালা মারা নেই। সবাই খুব খুশি হয়েই ওই দরজা দিয়ে ভিতরে যেতে রাজি হয়ে গেল। ভিতরে ঢুকে ওরা যেন সূর্যের নিষ্করুণ দহন থেকে রেহাই পেল। বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে ওরা জঙ্গলে পৌঁছল। প্রায় দুই একর জায়গা জুড়ে বিভিন্ন গাছপালায় ভরে আছে জঙ্গলটা। লার্চ, লরেল আর বিচ গাছের লম্বা লম্বা ডালগুলো সযত্নে সুন্দর করে কেটে রাখা হয়েছে। এই জঙ্গল দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে যথেষ্ট যত্নসহকারে সাজিয়ে রাখা, তবু রোদে খাঁ খাঁ করা বসার জায়গাটা বা বোলিং খেলার জায়গাটার তুলনায় অনেক বেশি ছায়া মাখা অন্ধকার ভাব আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দলের সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে সবাই চারপাশটা উপভোগ করছে। শেষমেশ, কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মিস ক্রফোর্ড বলল, “মিস্টার বার্ট্রাম, তাহলে তুমি একজন ধর্মযাজক হবে! এটা শুনে আমি কিন্তু বেশ চমকে গিয়েছি।“

“কেন বলো তো! এতে তোমার অবাক হওয়ার কী আছে? কোনও না কোনও পেশায় তো আমাকে যেতেই হবে। আর আমাকে দেখেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে আমি আইনজীবী, সৈনিক বা নাবিক, এসবের কিছুই নই!”

“সে তো ঠিকই। তবে এক কথায় বলতে গেলে এই সম্ভাবনার কথাটা আমার মাথায় আসে নি। আর সাধারণত দেখা যায় কোনও না কোনও দাদু, কাকু বা মামা পরিবারের দ্বিতীয় ছেলের জন্য কিছু সম্পত্তি উত্তরাধিকার হিসেবে রেখেই যান।“

“এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় রীতি, কিন্তু সবসময় এরকম হয় না। আমি সেই ব্যতিক্রমদের একজন। আর সেই কারণেই আমাকে নিজের জন্য কিছু একটা করতে হবে,” বলল এডমন্ড।

“কিন্তু তার জন্য তোমাকেই বা ধর্মযাজক হতে হবে কেন? আমি তো ভাবতাম, যে পরিবারে অনেক ছেলেমেয়ে থাকে সাধারণত সেই পরিবারের ছোট ছেলেই ধর্মযাজক হয়।“

“তাহলে তোমার কী মনে হয় কেউই নিজের পছন্দে এই ধর্মযাজকের পেশায় আসে না?”

“‘কখনোই না’ শব্দটা বেশ জোরালো। কিন্তু হ্যাঁ, সাধারণ কথাবার্তায় যার মানে হয় ‘প্রায় কখনোই না’, সেই অর্থে আমি তা-ই ভাবি। গির্জায় আর কীই বা করা যায়? পুরুষেরা তো নিজেকে আলাদা করে তুলতে চায়, আর সেটা অন্য যে পেশাতেই করা সম্ভব হোক না কেন, গির্জায় ধর্মযাজকের পেশায় নয়। একজন ধর্মযাজকের কোনো গুরুত্বই নেই।”

“‘কখনোই না’ শব্দটার মতোই ‘গুরুত্ব নেই’ কথাটারও অনেক মাত্রা আছে, তাই না? একজন ধর্মযাজক সমাজে বিশাল উঁচু কোনও জায়গা অধিকার করে না। তিনি অনেকের নেতা হয়ে ওঠেন না, বা সবাই কেমন নতুন পোশাকআশাক পরবেন সেটাও ঠিক করেন না। কিন্তু তাই বলে ওই পদটাকে — যাঁর দায়িত্ব মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো দেখা — ব্যক্তি বা সমাজ হিসেবে, এ জন্মে এবং পরকালেও, তাকে আমি ‘কিছু না’ বলতে পারি না। একজন ধর্মযাজকের দায়িত্ব ধর্ম আর  নীতিনৈতিকতা রক্ষা করা, আর সেখান থেকেই তো ভালো ব্যবহার বা আচার-আচরণের জন্ম। এখানে কেউই তো এই দায়িত্বকে ‘কিছু না’ বলতে পারে না। যদি কোনো ধর্মযাজক ‘কিছু না’ হয়ে থাকেন, তাহলে সেটা তাঁর দায়িত্ব অবহেলার কারণেই।”

“যতোটা সাধারণত শোনা যায়, বা আমি যতোটা বুঝি, তুমি দেখছি তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছ এই ধর্মযাজকের পদটাকে। সমাজে তো আমরা এঁদের এমন কিছু প্রভাব দেখি না। আর সেটা হবেই বা কী করে, ওঁরা নিজেরাও তো খুব একটা এগিয়ে আসেন না। তুমি যেমন বলছ, একজন ধর্মযাজক কি সপ্তাহে দুটো ধর্মের বাণী দেওয়া বক্তৃতা দিয়ে সাধারণ মানুষের তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছেড়ে ব্লেয়ারের বাণী মেনে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবে? সে যতই জ্ঞানগর্ভী হোক না কেন সেই সব ভাষণ। এভাবে কি ওই ধর্মসভায় উপস্থিত সকলে সারা সপ্তাহ কেমন আচরণ করবে তা ঠিক করে দেওয়া যায়? একজন ধর্মযাজককে তো তাঁর নিজস্ব মঞ্চ ছাড়া সেভাবে আর কোথাও দেখাই যায় না।“

“তুমি তো শুধু লন্ডনের কথা বলছ, আর আমি সামগ্রিক ভাবে গোটা দেশের কথা বলছি।“

“আমার তো মনে হয় গোটা দেশের প্রেক্ষিতে বড় শহরগুলো যথেষ্ট ভালো উদাহরণ।“

“না, আমার মনে হয় না গোটা দেশের প্রেক্ষিতে বড় শহরগুলো ভালো উদাহরণ হতে পারে। বড় বড় শহরে আমরা কখনই আমাদের নীতিবোধ খুঁজতে যাই না। সেখানে যে ধর্মযাজকরা খুব ভালো কিছু করতে পারেন, তা নয়। বা সেখানেই যে ধর্মযাজকদের আসল প্রভাব পড়ে, এমনটা তো একেবারেই নয়। একজন ভালো বক্তাকে হয়তো লোকে অনুসরণ করে, পছন্দ করে, কিন্তু একজন সত্যিকারের ধর্মযাজক শুধু ভালো বক্তা হওয়ায় থেমে থাকেন না — তিনি তাঁর চারপাশের লোকদের সঙ্গে মিশে কাজ করেন। ছোট জায়গায় তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র দেখা যায়, তাঁর আচরণ পর্যবেক্ষণ করা যায় — যেটা লন্ডনে সম্ভব নয়। ওখানে একটা বড় অংশের মানুষের কাছে তাঁরা শুধুমাত্র বক্তা হিসেবেই পরিচিত। আর মিস ক্রফোর্ড, যদি মানুষের জীবনে প্রভাবের কথা বলো, তাহলে আমকে ভুল বুঝো না, কিন্তু আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা এই যে তাঁরা মানুষের ভালো হয়ে ওঠায় সাহায্য করেন। মানুষ হিসেবে আরও ভালো হয়ে ওঠা, ভদ্রতা বোধ বা জীবন কেমন করে যাপন করা উচিত সেটাই শিখতে সাহায্য করেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, আমি যে আচরণের কথা বলতে চাইছি, তাকে শুধু আচরণ না, হয়তো চরিত্র বলা যেতে পারে। যা হয়তো ভালো নীতিবোধের ফলাফল। এক কথায় বললে, এই সব নীতিবোধ শেখানো বা প্রচার করাই একজন ধর্মযাজকের দায়িত্ব। আর আমি বিশ্বাস করি তার ফলে একজন ধর্মযাজকের যেমন হওয়া উচিত, তিনি সেরকম নাকি অন্যরকম, তার উপরেই সাধারণ মানুষের, জাতির আচার আচরণ নির্ভর করে।“

“তা তো বটেই!” খুব নরম আন্তরিকতার সুরে বলে উঠল ফ্যানি।

“আরে এইতো! দেখো, তুমি ইতিমধ্যেই মিস প্রাইসকে যথেষ্ট একমত করে ফেলেছ!”, হইহই করে মিস ক্রফোর্ড বলে উঠল।

“ইশ, যদি মিস ক্রফোর্ডকেও আমার সঙ্গে সহমত করে তুলতে পারতাম!”

একটু দুষ্টু হাসি হেসে মিস ক্রফোর্ড বলল, “আমার মনে হয় না, সেটা তুমি কোনদিনই করতে পারবে। প্রথমে শুনে যতোটা অবাক হয়েছি, সেরকমই আমি তো এখনও ভাবতেই অবাক হচ্ছি যে তুমি ধর্মযাজক হবে। এর থেকে আরও ভালো অনেক কিছু করতে পারো তুমি। শোনো, এখনও সময় আছে, সেরকম দেরি হয় নি, তুমি তোমার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলো। তুমি বরং আইনের পেশায় ঢুকে পড়ো।“

“আইনের পেশায় ঢুকব! হে ঈশ্বর! যতো সহজে এই জঙ্গলে এসে ঢুকলাম, সেরকম সহজ নাকি ব্যাপারটা!”

"এবার আমি আগে থেকেই বলে দিচ্ছি যে এখন তুমি নিশ্চয়ই বলবে যে আইন আর জঙ্গলের মধ্যে আইনটাই বেশি খারাপ! মনে রেখো, তুমি কী বলতে পারো, আমি কিন্তু সেটা আগেই ধরে ফেলেছি।"

“আরে, আমি যাতে সেরকম মজার কিছু না বলে ফেলি, সেটা আটকানোর জন্য তোমাকে অত তাড়াহুড়ো করতে হবে না। ওরকম রসিকতা করা আমার স্বভাবই নয়। আমি খুবই সাদাসিধা, স্পষ্টবক্তা একজন মানুষ। আমি হয়তো রসিকতা করার চেষ্টা করতে করতে আধঘণ্টা ধরে ঘুরেফিরে এক জায়গায় আটকে থাকব, তবুও ঠিকঠাক কোনো বুদ্ধিদীপ্ত কথা বের করতে পারব না।“

সবাই চুপচাপ নিজের নিজের ভাবনায় ডুবে রইল কিছুক্ষণ। সবার প্রথমে ফ্যানি সেই নিরবতা ভাঙল। বলে উঠল, “আমি ভাবতে পারি নি যে এই এতো সুন্দর জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতেও আমি ক্লান্ত হতে পারি। কিন্তু এরপর কোথাও বসার জায়গা পেলে, যদি তোমাদের আপত্তি না হয়, সেখানে একটু বসতে পারলে আমি বর্তে যাব।“

সঙ্গে সঙ্গে ফ্যানির হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে একটু হইহই করে বলে উঠল এডমন্ড, “আরে ফ্যানি, কী রকম জ্ঞানগম্যিহীন মানুষ আমি দেখেছ! খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে পড় নি তো তুমি?” তারপর মিস ক্রফোর্ডের দিকে ফিরে বলল, “আমার অন্য সঙ্গীর হাতটাও কি ধরার সৌভাগ্য হবে আমার?” 

"ধন্যবাদ, তবে আমি কিন্তু একেবারেই ক্লান্ত নই," বললেও কথাটা বলতে বলতেই মিস ক্রফোর্ড এডমন্ডের হাত ধরল। আর মিস ক্রফোর্ড ওর হাতটা ধরতেই, প্রথমবারের জন্য এমন এক ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে এডমন্ড ফ্যানিকে যেন কিছুটা ভুলেই গেল।

“আরে, তুমি তো আমাকে ভালো করে ধরছই না। তুমি তো দেখি আমাকে কোনো কাজেই লাগাচ্ছো না। একটা মেয়ের আর একটা ছেলের বাহুর ভারে কত যে তফাৎ! অক্সফোর্ডে তো কতসময় কোনও কোনও ছেলে আমার উপর ভর দিয়ে পুরো রাস্তা হেঁটে যেত, আর সেই তুলনায় তুমি তো যেন একটা মাছি!"

"আসলে কী বলো তো, আমি সত্যিই ক্লান্ত নই। আর এটা ভেবে আমার বেশ অবাকই লাগছে। এই জঙ্গলের ভিতরে আমরা অন্তত এক মাইল তো হেঁটেইছি। তোমার কি তাই মনে হয় না?"

"মোটেই না, এক মাইল তো দূরের কথা, আধ মাইলও হাঁটি নি আমরা," এডমন্ড দৃঢ়ভাবে বলল। ও তখনও প্রেমে এত ডুবে যায়নি যে মেয়েদের মতো অযৌক্তিক ভাবে সময় আর দূরত্বের হিসেব ভুলে যেতে পারে। “আর আমরা যে কতটা এদিকওদিক করেছি, সেটাও তো তুমি হিসেবে ধরছ না। আমরা যেরকম আঁকাবাঁকা রাস্তায় এগোচ্ছি! এই জঙ্গলটা একদম সোজাসুজি দেখলে হয়তো আধ মাইল মতন লম্বা হবে। আর সেই মূল রাস্তা ছাড়ার পর থেকে আমরা তো এখনও জঙ্গলের শেষ সীমানাটা দেখতেই পাই নি। তবে যদি তুমি মনে করে দেখো, তাহলে বুঝবে যে আমরা যখন সেই মূল রাস্তা ছেড়ে এলাম, তখন কিন্তু রাস্তাটার একেবারে শেষ মাথা পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলাম। পুরো রাস্তাটার শেষে লোহার গেট দেখা যাচ্ছিল। আর সেটা এক ফার্লং এর বেশি দুরত্বের হতেই পারে না।"

“ধ্যাত, তোমার ওসব ফার্লং টার্লঙ্গের কিছু বুঝি না বাপু, তবে এটুকু জানি যে জঙ্গলটা বেশ বড়। আর এটাও জানি যে এখানে আসার পর থেকে আমরা হেঁটে হেঁটে ঘুরেই চলেছি। তাই আমি যখন বলছি যে প্রায় এক মাইল হেঁটেছি, তখন সেটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই বলছি।“

পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময়টা দেখে এডমন্ড বলল, “আমরা ঠিক পনেরো মিনিট ধরে এখানে হাঁটছি। তো, তোমার কি মনে হয় যে আমরা ঘণ্টায় চার মাইল বেগে হাঁটছি?”

“শোনো, ওসব ঘড়ি ফরি দেখাবে না আমাকে। তুমি খুব ভাল করেই জানো যে ঘড়ি কখনও সময়ে চলে না। কখনও বড্ড তাড়াতাড়ি চলে, আবার কখনও যেন চলতেই চায় না। তাই ওই ঘড়ির সময় ধরে আমি চলতে পারব না, বলে দিচ্ছি।“

আরও কয়েক পা হাঁটার পর যেটা নিয়ে এতক্ষণ কথা হচ্ছিল, রাস্তার সেই শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছল ওরা। ছায়া আর গাছপালায় ঘেরা একটা আরামদায়ক বেঞ্চ রয়েছে সেখানে। জায়গাটা একটা নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। রাস্তার এই শেষ প্রান্ত থেকে ওই নিচু পাঁচিলটা পেরিয়ে পার্কটা দেখা যাচ্ছিল। ওরা তিনজন ওই বেঞ্চেই বসে পড়ল।  

ফ্যানির দিকে তাকিয়ে এডমন্ড বলল, "আমার তো মনে হচ্ছে, তুমি খুব ক্লান্ত, তাই না ফ্যানি? আগে কেন কিছু বললে না? যদি বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ো, তাহলে আজকের আনন্দটাই মাটি হবে। ফ্যানি খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, মিস ক্রফোর্ড। শুধু ঘোড়ায় চড়তেই ওর কোনও ক্লান্তি নেই।"

“এদিকে আমি তো পুরো সপ্তাহ ওর ঘোড়াটা আটকে রেখেছিলাম। না এডমন্ড, তাহলে তো তুমি ঠিক করো নি আমাকে সেটা করতে দিয়ে। শুধু যে আমার ব্যবহারেই তা নয়, তোমার ব্যবহারেও আমার খুব লজ্জা লাগছে। এটা আর কখনও হবে না। ফ্যানির প্রতি তোমার যত্ন আর মনোযোগ আমাকে আমার অবহেলা সম্পর্কে আরও সচেতন করে দিলো। বুঝতে পারছি ফ্যানির দায়িত্ব তোমার হাতেই যেন বেশি নিরাপদ। তবে, ও যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাতে আমি একটুও অবাক হচ্ছি না। সারা সকাল ধরে এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যা যা করেছি, এতো বড় বাড়ি ঘুরে দেখা, একটা ঘর থেকে আরেকটা ঘর দেখে বেরানো, চোখ আর মনের উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে। যা বুঝি না, সেটা শোনা, যেটা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা থাকার কথা নয়, সেটা দেখেও প্রশংসা করা, এসব পৃথিবীর সবথেকে বিরক্তিকর কাজ। মিস প্রাইস সেটা সেভাবে ভালো করে অনুভব না করলেও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে।"

"আর একটু বিশ্রাম নিলেই আমি ঠিক হয়ে যাবো, এমন সুন্দর একটা দিনে ছায়ায় বসে সবুজ গাছপালা দেখা, এর থেকে বেশি শান্তির বিশ্রাম আর কী হতে পারে!" ফ্যানি বলল।

কিছুক্ষণ বসে থেকে মিস ক্রফোর্ড আবার উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমি আর বসে থাকতে পারছি না। বিশ্রামই আমাকে ক্লান্ত করে দেয়। এতক্ষণ ওই নিচু পাঁচিলের উপর দিয়ে ওপাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন যাই, যদিও ভালো করে দেখা যাবে না, তবুও ওই লোহার গেটটা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বরং।"

এডমন্ডও উঠে দাঁড়াল। "মিস ক্রফোর্ড, এখন রাস্তাটার দিয়ে তাকালেই তুমি বুঝতে পারবে, এটা আধ মাইল তো দূরের কথা, আধ মাইলের অর্ধেকও না।"

“কই, আমার তো মনে হচ্ছে রাস্তাটা অনেক লম্বা। বেশ এক ঝলক তাকিয়েই আমি সেটা বুঝতে পারছি।“

এডমন্ড তাও কিছুক্ষণ ওকে বোঝানোর চেষ্টা করল, তবে সেসব কথাই জলে গেল। মিস ক্রফোর্ড না মেপে দেখবে, না তুলনা করবে। শুধু হাসবে আর নিজের মতে অনড় থাকবে। দুনিয়ার সবথেকে বড় যুক্তিতর্কের আলোচনাও এই আলোচনার থেকে বেশি মনোগ্রাহী হতে পারত না। দুজনেই এই অকারণ বাক্যালাপে ভারী আনন্দিত। শেষে ঠিক হলো, জঙ্গলটা মাপার জন্য ওরা আরও কিছুটা হেঁটে দেখবে। ওরা সোজা পথে হেঁটে জঙ্গলের এক মাথায় যাবে, আর যদি দরকার মনে হয়, অন্য কোন দিকেও একটু যাবে। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবে। ফ্যানি বলল ও যথেষ্ট বিশ্রাম নিয়েছে, এবার ও হাঁটতে পারবে। কিন্তু ওরা দুজন কেউই সেটা মানতে রাজি হলো না। এডমন্ড এতো আন্তরিকভাবে ওকে বসেই থাকতে বলল, যে ফ্যানি আর না বলতে পারল না। বেঞ্চে বসে বসে এডমন্ড যে কতটা ওর কথা ভাবে সেটা ভাবতে যতই ভালো লাগুক, ও যে যথেষ্ট শক্তপোক্ত নয়, সেটা ভেবেও আফসোস হলো ফ্যানির। বেঞ্চে বসে ও এডমন্ড আর মিস ক্রফোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না হাঁটতে হাঁটতে মোড় ঘুরে যায় আর কান পেতে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না ওদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়।