
জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক - ষষ্ঠ পর্ব
- 07 May, 2025
- লেখক: সুস্মিতা সরকার
টম তো চলে গেল। ইতিমধ্যে দুই পরিবারের এতোটাই সখ্য হয়ে গিয়েছে যে প্রায় রোজই তাদের দেখা হয়েছে, তাই মিস ক্রফোর্ড ধরেই নিল যে তার সামাজিক জীবনে একটা বড়সড় শূন্যতা তৈরি হবে আর টমের জন্য মন কেমন করবে। টম চলে যাওয়ার পর দুই পরিবারের সবাই যখন বার্ট্রামদের বাড়িতে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করার জন্য বসল তখন মিস ক্রফোর্ড ইচ্ছে করেই খাওয়ার টেবিলের সেই দিকে বসল যেদিকে সাধারণত পরিবারের কর্তা বসে। এখন টমের অনুপস্থিতিতে পরিবারের কর্তার চেয়ারে ছোটভাই এডমন্ড বসেছে। মিস ক্রফোর্ড নিশ্চিত ছিল যে এডমন্ডের কাছাকাছি বসলে টমের জন্য আরও বেশি মন খারাপ করবে। কারণ টমের সঙ্গে খুব সুন্দর বাক্যালাপ চালানো গেলেও এডমন্ড তো সেরকম কথাই বলে না। দুই ভাইয়ের এই বিপরীত স্বভাবের কারণেই মিস ক্রফোর্ড টমের জন্য তার সত্যিই কতটা মন খারাপ করছে সেটা বুঝতে এডমন্ডের পাশে বসেছে।
খাওয়া শুরু হলো স্যুপ দিয়ে। সবাই খুব কেজো ভঙ্গিতে স্যুপ নিলো। ওয়াইনে চুমুক দিচ্ছে অথচ কারোর ঠোঁটে নেই একটুকরো হাসি, নেই কোনও ছোটোখাটো হাসি ঠাট্টার মুহূর্ত। গৃহকর্তা হিসেবে এডমন্ড হরিণের মাংস কাটল। কিন্তু টম যেমন মাংস কাটার সময় পুরনো মজার গল্প বা “আমার একটা বন্ধু ছিল” দিয়ে শুরু করা কোনও মজার কাহিনী শোনাত, সেরকম কিছু হলো না। নাঃ, এর থেকে টেবিলের অপর প্রান্তে কী হচ্ছে সেদিকে মনোযোগ দেওয়াই বরং ভালো।
ক্রফোর্ড ভাইবোনের এখানে আসার পর এবারই প্রথম এসেছে মিস্টার রাশওয়ার্থ। সে পাশের জেলায় এক বন্ধুর কাছে গিয়েছিল। সেই বন্ধুর বাড়ির বাগান নতুন করে পেশাদার লোক দিয়ে সাজানো হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরা ইস্তক তার নিজের বাড়িটাকেও কী করে আরও সুন্দর করে সাজানো যায় সেই চিন্তাই মিস্টার রাশওয়ার্থের মাথায় ঘুরঘুর করছে। যদিও খুব একটা কাজের কিছু বলছে না, কিন্তু আপাতত তার মুখে এই এক বিষয় ছাড়া আর কোনও কথা নেই। এই একই বিষয় নিয়ে আগে বসার ঘরে একবার আলোচনা হয়ে গিয়েছে। আবার সেই একই কথা শুরু হয়েছে খাবার ঘরে। মারিয়া এই বিষয়ে কী ভাবছে সেটা বোঝাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। মারিয়ার মধ্যে মিস্টার রাশওয়ার্থকে খুশি করার কোনও চেষ্টা তো নেইই, বরং যেন এক ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞার ভাব রয়েছে। তারপরও যেহেতু 'সোথারটন কোর্ট'-এর নাম এবং তার সঙ্গে জড়িত বিষয় তাকে একটা সন্তুষ্টি যোগায়, তাই সে এই মুহূর্তে খুব একটা রুঢ় ব্যবহার করছে না।
"ইশ, তুমি কম্পটন জায়গাটা যদি দেখতে!" এত সুন্দর! জীবনে আমি কোনও একটা জায়গাকে এতটা বদলে যেতে দেখিনি। স্মিথকে তো বললাম, আমি যে কোথায় আছি, সেটাই বুঝতে পারছি না। সেখানে ঢোকার রাস্তাটা দেশের সবথেকে সেরা রাস্তাগুলোর মধ্যে একটা বলা চলে। রাস্তা দিয়ে ভিতরে ঢুকে হঠাৎ বাড়িটা দেখলে যেন চমকে উঠতে হয়। গতকাল সোথারটনে ফিরে এসে সত্যি বলছি মনে হচ্ছে যেন একটা জেলখানায় এসে পড়েছি – একটা পুরনো, দমবন্ধ করা জেলখানা।“ মিস্টার রাশওয়ার্থ বলল।
“এমা! ছি, ছি, একী কথা! জেলখানা! সত্যি! সোথারটন কোর্ট পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর জায়গা। তাকে জেলখানা বলছ! একথা বলার জন্য তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ।“ মিসেস নরিস হইহই করে উঠলেন।
“কিন্তু বাড়িটাতে অনেক কাজ করানোর দরকার ম্যাডাম। এত খারাপ হালের বাড়ি আমি জীবনে আর একটাও দেখি নি। বাড়িটা এত পুরনো, জীর্ণ আর নির্জন যে আমি জানি না এই বাড়িটার কী করে কী উন্নতি করা যেতে পারে।“
"এখন মিস্টার রাশওয়ার্থের এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, তবে সে কোনও ব্যাপার না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওর যেমন মন চায়, সোথারটনে সেসব কিছুই হয়ে যাবে।“ মিসেস গ্রান্ট মৃদু হেসে মিসেস নরিসকে বললেন।
“সেক্ষেত্রে মিস্টার রেপটনই তোমার সবথেকে বেশি কাজে আসতে পারে বলে আমার মনে হয়।“ মারিয়া বলল।
“আমারও সেটাই মনে হচ্ছে। স্মিথের বাড়িতে তিনি যেরকম কাজ করেছেন, তাতে আমার মনে হয় ওঁর সঙ্গে এক্ষুনি যোগাযোগ করাটাই বোধহয় ভালো হবে। দিনে পাঁচ গিনি পারিশ্রমিক নেন তিনি।“
মিসেস নরিস জোরে জোরে বলে উঠলেন, “সে যদি দিনে দশ গিনিও নেন, আমি তো বলব তাতেও তোমার চিন্তার প্রয়োজন নেই। খরচের জন্য কোনও কিছু যেন আটকে না থাকে। আমি হলে তো খরচের কথা ভাবতামই না। সবকিছু যতোটা সম্ভব সুন্দর করে সাজাতাম। সোথারটন কোর্টের মতন একটা জায়গা রুচিসম্মতভাবে সাজিয়ে রাখাই উচিৎ, সেজন্য যতই খরচ হোক না কেন। ওখানে কাজ করানোর জন্য অনেক জায়গা আছে। ওই বাড়ির বাগানটা সুন্দর করে সাজালে সেটা তোমাকে সত্যিই এক বিরাট তৃপ্তি দেবে। যদি আমার কথা বলতে হয়, তাহলে বলি, যেহেতু আমার ভীষণ ভালো লাগে, তাই যদি আমার সোথারটন কোর্টের অর্ধেক জায়গাও থাকত, তাহলে আমি তো সারাক্ষণ গাছপালা লাগানো আর সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম।
এখন আমি যেখানে থাকে সেটা খুব ছোট্ট একটা জায়গা। মাত্র আধা একর। সেখানে এসব কিছু করার চেষ্টা অবশ্য খুবই হাস্যকর একটা প্রচেষ্টা হবে, প্রায় রসিকতা করার মতোই। তবে যদি আমার আরও জায়গাজমি থাকত, তাহলে গাছপালা লাগিয়ে, সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে আমার খুব ভালো লাগত। যখন চার্চের বাড়িতে থাকতাম, তখন কিন্তু আমরা অনেক কিছু করেছি। প্রথম যখন এসেছিলাম তখন যেমন ছিল, তার থেকে অনেক আলাদা করে তুলেছিলাম আমরা জায়গাটাকে। তোমরা তখন অনেক ছোট ছিলে, হয়তো খুব একটা মনে নেই। তবে আমাদের প্রিয় স্যর থমাস এখানে থাকলে বলতে পারতেন যে জায়গাটাকে কতটা সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছিলাম আমরা। আরও অনেক উন্নতি করা যেত যদি না বেচারা মিস্টার নরিসের স্বাস্থ্যটা এত খারাপ হয়ে পড়ত। তিনি বেচারা তো বাইরে বেরোতেই পারতেন না। কিছুই উপভোগ করতে পারতেন না। তাই আমারও মনটা এত খারাপ হয়ে যেত যে স্যর থমাস আর আমি যা কিছু করার কথা আলোচনা করতাম সেসবের কিছুই করতে ইচ্ছে করত না। নাহলে বাগানের দেওয়ালটাও আমরা গাছ দিয়ে ঢেকে ফেলতাম যাতে গির্জার কবরস্থানটা আড়াল হয়ে যায়, যেমন এখন ডক্টর গ্রান্ট করেছেন। তবুও, আমরা সবসময় কিছু না কিছু করতাম। মিস্টার নরিসের মৃত্যুর আগের বসন্তেই আমরা ঘোড়ার আস্তাবলের দেওয়ালের পাশে অ্যাপ্রিকট গাছটা লাগিয়েছিলাম। গাছটা এখন কত বেড়ে উঠেছে, আর দেখতে কী যে সুন্দর লাগে, তাই না বলুন মশাই!” নিজের মনেই কথাগুলো বলে মিস্টার গ্রান্টের দিকে তাকালেন মিসেস নরিস।
মিস্টার গ্রান্ট উত্তর দিলেন, “তা ঠিক ম্যাডাম, গাছটা যে সত্যিই দারুণ বড়সড় হয়ে উঠেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মাটিটা খুবই ভালো। কিন্তু ফল তোলার পর প্রত্যেকবার ভারী আফসোস হয় যে এত কষ্ট করে ফল তোলার কী দরকার! খেতে তো একেবারে অখাদ্য।“
“শুনুন মশাই, এটা কোনও যাতা জাতের না, একেবারে মুর পার্ক জাতের এপ্রিকট। অন্তত আমরা তো মুর পার্ক জাতের এপ্রিকট হিসেবেই কিনেছিলাম। যদিও স্যর থমাস এই গাছটা উপহার দিয়েছিলেন আমাদের। তবে আমি তো বিলটা দেখেছি, এটার দাম পড়েছিল সাত শিলিং, যেমন মুর পার্ক জাতের এপ্রিকট গাছের দাম হয়।“ মিসেস নরিস বললেন।
“এক্কেবারে ডাহা ঠকানো হয়েছিল ম্যাডাম আপনাদের। এই আলুগুলোতে যতোটা মুর পার্ক এপ্রিকটের স্বাদ, বলা যেতে পারে যে ওই গাছের ফলগুলোতেও মুর পার্ক এপ্রিকটের স্বাদ ঠিক ততোটাই। একদম পানসে। কোনো স্বাদ নেই। ভালো এপ্রিকট অন্তত খাওয়ার যোগ্য হয়, কিন্তু আমার বাগানের কোনো ফলই খাওয়ার মতো না।" মিস্টার গ্রান্ট উত্তর দিলেন।
টেবিলের উল্টো দিকে বসা মিসেস গ্রান্ট মিসেস নরিসের দিকে ঝুঁকে যেন ফিসফিস করে কোনও গোপন কথা বলছেন এমন ভান করে বললেন, “সত্যি কথা বলতে কী, ডক্টর গ্রান্ট আমাদের বাগানের এপ্রিকটের স্বাদ কেমন সেটাই জানেন না। ফলটা এত দামি আর বড় যে আমাদের রাঁধুনি আগেই সব ফল নিয়ে নেয় টার্ট বানানোর জন্য, বা পরে খাওয়ার জন্য শুকিয়ে রাখার জন্য। আর তাই তিনি একটা ফলও খাওয়ার সুযোগ পান না।“
মিসেস নরিস ধীরে ধীরে রাগে লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন। মিসেস গ্রান্টের কথায় এবার তিনি একটু ঠাণ্ডা হলেন। এরপর সোথারটনের উন্নতি নিয়ে আলোচনার জায়গায় অন্য নানান বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা চলল। ডক্টর গ্রান্ট আর মিসেস নরিসের খুব একটা বনে না। পরিচয়ের শুরু থেকেই তাঁদের মধ্যে নানান ঝামেলা লেগে থাকে। তাঁদের স্বভাবও একদম আলাদা।
একটু পরে মিস্টার রাশওয়ার্থ আবার বলল, "স্মিথের জায়গাটা এখন পুরো এলাকার গর্ব! অথচ যতক্ষণ না রিপটন এসে জায়গাটা সাজিয়ে দিলেন ততদিন পর্যন্ত সেটা বলার মতন কিছুই ছিল না। আমি ভাবছি রিপটনকেই নিয়োগ করব।"
মারিয়া বলল, “মিস্টার রাশওয়ার্থ, আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম তাহলে খুব সুন্দর ঝোপঝাড় দিয়ে বাগানটা সাজাতাম। আবহাওয়া ভালো থাকলে ওরকম বাগানে হাঁটতে খুব ভালো লাগে।“
তার নিজের ব্যাপারে মারিয়ার মতামত যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝানোর জন্য মিস্টার রাশওয়ার্থ খুব উদগ্রীব হয়ে কিছু প্রশংসাসূচক কথা বলতে চাইল। কিন্তু একদিকে মারিয়ার পছন্দ মেনে নেওয়া, আবার ঠিক একই কথা যে সে নিজেও ভেবেছে সেটাও জানানো, আর সাধারণ ভাবে সে যে মহিলাদের সুযোগ সুবিধার প্রতি মনোযোগ দেয় সেকথা জানিয়েও অন্যদিকে আকারইঙ্গিতে এটাও প্রকাশ করা যে স শুধুমাত্র মারিয়াকেই খুশি করতে চাইছে, সবকিছু মিলিয়ে তার তালগোল পাকিয়ে গেল। ফলে সে কিছুই সেভাবে বলতে পারল না। তাই দেখে এডমন্ড অবস্থা সামাল দিতে ওয়াইন পরিবেশন করার প্রস্তাব দিল।
মিস্টার রাশওয়ার্থ সাধারণত খুব বেশি কথা বলে না। তবে তার এত পছন্দের বিষয়ে কথা বলা এখনও শেষ হয় নি। তাই আবার বলতে শুরু করল, “স্মিথের খুব বেশি জমি নেই, মোটামুটি একশ একর মতন ওর বাগানটা। তবুও জায়গাটা এখন এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে যে দেখলে অবাক হতে হয়। এদিকে আমাদের সোথারটনে তো জলভরা জমি বাদ দিলেও প্রায় সাতশো একর জমি আছে। তাই আমার মনে হচ্ছে, যদি কম্পটনে এত কিছু করা যায়, তাহলে সোথারটন নিয়েও আশা ছাড়ার কিছু নেই। ওদের ওখানে বাড়ির কাছাকাছি দুটো তিনটে পুরনো গাছ কাটতে হয়েছে। তাতে বাড়ির চারপাশটা অদ্ভুতভাবে দারুণ খোলামেলা হয়ে গিয়েছে। সব দেখে মনে হচ্ছে রিপটন বা ওরকম কেউ হয়তো আমাদের সোথারটনের মূল রাস্তার পাশের গাছগুলোও কেটে ফেলবেন।“ এরপর সোজাসুজি মারিয়ার দিকে তকিয়ে বলল, “যে রাস্তাটা পশ্চিম দিক থেকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গিয়েছে, আমি সেই রাস্তাটার কথা বলছি, বুঝলে তো?”
মারিয়া খুব ভদ্র ভাবেই উত্তর দিলো, “কোন রাস্তাটা! আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। আসলে আমি সোথারটনের ব্যাপারে বিশেষ কিছুই জানি না।“
ফ্যানি এডমন্ডের উল্টোদিকে, মিস ক্রফোর্ডের ঠিক বিপরীতে বসে ছিল এবং মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনছিল। ও এবার এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, “রাস্তার ধারের সব গাছগুলো কেটে ফেলা হবে! ইশ! কী আফসোস! এটা শুনে কাউপারের কথা মনে পড়ছে না তোমার? ‘Ye fallen avenues, once more I mourn your fate unmerited.’”
এডমন্ড একটু হেসে জবাব দিল, "ভয় হচ্ছে রাস্তার ধারের গাছগুলোর ভাগ্য ভালো নয়, বুঝলে ফ্যানি।"
ফ্যানি বলল, "সোথারটনের গাছগুলো সব কেটে ফেলার আগে এখন কেমন দেখায় সেটা আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মনে হয় না সেটা সম্ভব হবে।"
"তুমি কি সেখানে কখনও গিয়েছো? না, না, সেখানে তুমি কী করে যাবে। আর দূরত্বও এমন যে ঘোড়ায় চড়েও যাওয়া সম্ভব নয়। ইশ, যদি কোনভাবে ঘোড়ায় চড়ে সেখানে যেতে পারতাম আমরা!”
“আরে, সে কোনও ব্যাপার না। আমি যখনই জায়গাটা দেখার সুযোগ পাই না কেন, তুমি আমাকে বলে দিয়ো যে কোথায় কী বদল হয়েছে, তাহলেই হবে।“
মিস ক্রফোর্ড বলল, “যতটুকু যা বুঝছি, তাতে এটাই বুঝতে পারছি যে সোথারটন বেশ পুরনো আর ঐতিহ্যপূর্ণ একটা জায়গা। বাড়িটা কি কোনো নির্দিষ্ট ধরনের স্থাপত্যে তৈরি?"
“বাড়িটা এলিজাবেথের সময়কালের। সাধারণ ইঁটের তৈরি একটা বিশাল বাড়ি। অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি বাড়িটায় অনেকগুলো ঘর আছে, আর বেশ ভারী গড়নের হলেও খুব অভিজাত দেখতে বাড়িটা। বাড়িটা যে জায়গায়, সেটা অবশ্য খুব একটা সুবিধার নয়। পার্কের সবথেকে নিচু জায়গা। তাই সৌন্দর্য বৃদ্ধির দিক থেকে একটু অসুবিধা আছে। তবে আশপাশের বনটা খুব সুন্দর, আর একটা ছোট নদীও আছে, যেটা একটু সাজালে দারুণ লাগবে। মিস্টার রাশওয়ার্থ যে একে নতুন করে আধুনিক সাজে সাজিয়ে তোলার চিন্তা করছে, একদম ঠিক করছে। আমার মনে হয় সবকিছু খুব সুন্দর ভাবেই হবে।"
মিস ক্রফোর্ড চুপচাপ এডমন্ডের সব কথা শুনল আর মনে মনে ভাবল, “ভদ্রলোক এতোটাই ভদ্র যে সবকিছুতেই ভালো দিকটা তুলে ধরে।“
এডমন্ড আরও বলল, “আমি মিস্টার রাশওয়ার্থকে প্রভাবিত করতে চাই না। তবে আমার নিজের কোনও জায়গা সাজাতে হলে আমি নিজেই ধীরে ধীরে গড়ে তুলতাম। তাতে হয়তো একটু কম সুন্দর সাজানো হত, তবুও আমি পেশাদার লোকের হাতে আমার জায়গা সাজানোর দায়িত্ব তুলে দিতাম না। অন্য কারোর ভুলের মাসুল গোনার থেকে আমি বরং আমার নিজের ভুলের দায় নিতে রাজি।“
মিস ক্রফোর্ড বলল, “সে নাহয় তুমি এসব ব্যাপারে বোঝো তাই এরকম করতে পারো। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা করা যাবে না একদমই। এরকম সাজানোর ব্যাপারে আমি বিশেষ কিছুই বুঝি না। একদম তৈরি অবস্থায় চোখের সামনে দেখলে অবশ্য আলাদা কথা। গ্রামের দিকে আমার নিজের জমিজায়গা থাকলে আমি তো খুশিমনে কোনো মিস্টার রিপটনকে সব দায়িত্ব দিতাম। তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যতটা সম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে দিতেন, আর আমি কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একবারও দেখতাম না।"
ফ্যানি বলল, “তবে আমার কিন্তু এই সাজানোর কাজটা কী করে একটু একটু করে এগিয়ে যায়, সেটা দেখতে খুবই ভালো লাগত।“
“সে তুমি সেরকম ভাবে বড় হয়ে উঠেছ তাই। আমার ছোটবেলায় এসব কিছু দেখিনি। এরকম সাজানোর ঘটনা একবারই দেখেছি আমি। সেটাও এরকম নয় যে প্রিয় কোনো মানুষের কাছে। তাই এরকম সাজানো বা উন্নয়নের কাজ আমার চরম বিরক্তিকর মনে হয়। তিন বছর আগের ঘটনা। গ্রীষ্মে সবাই মিলে যাওয়ার জন্য অ্যাডমিরাল, মানে আমার সম্মানিত কাকা, টুইকেনহ্যামে একটা কটেজ কিনেছিলেন। কাকিমা আর আমি তো প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ। জায়গাটা ভারী সুন্দর। অথচ কাকার মনে হলো কটেজটায় কিছু কাজ করানোর দরকার। এরপর তিনমাস ধরে শুধু ধুলোবালি আর বিশৃঙ্খলা। একটু শান্তিতে হাঁটার উপায় নেই, বসার জায়গা নেই। আমি চাই গ্রামের বাড়ি সুন্দর করে সাজানো থাকুক, গাছগাছালি, ফুলের বাগান, আর বসার জন্য অসংখ্য ছোট ছোট বেঞ্চ, সবই থাকুক; তবে সেটা করার জন্য আমি নিজের মাথা ঘামাতে চাই না। হেনরি অবশ্য আলাদা, ওর এসব কাজে মজা লাগে।"
মিস ক্রফোর্ডের মুখে তার কাকার নামে এত খোলামেলা সমালোচনা শুনে এডমন্ডের একটু খারাপ লাগল। তার শালীনতার ধারণার সঙ্গে এটা একদম মানানসই না। সে চুপ করে গেল, যদিও মিস ক্রফোর্ডের হাসিখুশি ভাব দেখে পরে কথাবার্তা আবার স্বাভাবিক হয়ে এল।
মিস ক্রফোর্ড বলল, "মিস্টার বার্ট্রাম, অবশেষে আমার হার্পের খবর পেয়েছি। হার্পটা নর্থহ্যাম্পটনে নিরাপদে আছে। গত দশদিন ধরে ওখানেই ছিল হয়তো। তা সত্বেও এতদিন ধরে বারবার আমাদের ভুল খবর দেওয়া হয়েছে।“
কথাটা শুনে একই সঙ্গে এডমন্ড খুশি আর অবাক হলো।
মিস ক্রফোর্ড আরও বলল, "আসলে কী বলো তো, আমরা খুব সরাসরি খোঁজখবর করছিলাম। লোক পাঠিয়েছি, নিজেরা গিয়েছি। কিন্তু লন্ডন থেকে সত্তর মাইল দূরে এভাবে খোঁজ করে কিছু হয় না। অবশেষে আজ সকালে ঠিকঠাকভাবে পদ্ধতিতে খবরটা পেলাম। একটা চাষি হার্পটা দেখেছে। সে মিলের মালিককে খবরটা বলেছে। সেই মিলের মালিক আবার কসাইকে গল্প করেছে। কসাই তার জামাইকে বলেছে আর শেষ পর্যন্ত সেই কসাইয়ের জামাই দোকানে এসে খবরটা দিয়ে গিয়েছে।“
“যেভাবেই হোক খবরটা যে পেয়েছ, সেটা শুনে খুব ভালো লাগছে। আশা করি এবার আর কোনো দেরি হবে না।"
“হার্পটা আমার কাল পাওয়ার কথা। তবে ওটা এখানে কী করে আনা যায় বলো দেখি? কোনও ওয়াগন বা ঘোড়ার গাড়ি তো পাওয়া যাবে না। সেরকম কিছু একটা যে ভাড়া করব সেটা আবার এই গ্রামে সম্ভবই না। কী মুস্কিল বলো তো! আমার প্রস্তাবে সবাই এমন করছে যেন আমি ঘোড়ার গাড়ি না, কুলি আর ঠেলাগাড়ি ভাড়া নিতে চাইছি।
“হ্যাঁ, তা অবশ্য তুমি ভাড়া নিতে পারবে না। এখন খড় কাটার কাজ শেষ করতে হবে। এই সময় ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।“
“আমি তো হতবাক! এই সামান্য বিষয়টাকে নিয়ে যে এমন ঝামেলা হবে কে জানতো! এই গ্রামে এমনিতে একটা ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া পাওয়া অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল। তাই আমার কাজের মেয়েটাকে বললাম একজন কারোর সঙ্গে সরাসরি এই ভাড়ার ব্যাপারে কথা বলতে। আমার সাজগোজের ঘর থেকে যেদিকেই তাকাই সেদিকেই তো শুধু খামার আর খামার। এমনকি একটা ঝোপঝাড় পেরোতে গেলেও একটা খামার পেরোতে হয়। তাই আমি তো ভাবলাম একবার বললেই পেয়ে যাব। উল্টে আমার তো এটা ভেবেই খারাপ লাগছিল যে আমি তো সবার থেকে এটা ভাড়া নিতে পারব না, তাই মাত্র একজনেরই উপকার হবে। এরপর যখন জানলাম যে ঘোড়া ভাড়া নিতে চেয়ে আমি নাকি পৃথিবীর সবথেকে অযৌক্তিক আর বিরক্তিকর বায়না করেছি, তখন আমার অবস্থাটা ভাবো একবার! আমি ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া নিতে চেয়েছি বলে গোটা গ্রামের সব চাষির দল, মজুরের দল সব নাকি রেগে গিয়েছে। এমনকি গ্রামের খড়গুলো পর্যন্ত নাকি আমার উপর ক্ষেপে গিয়েছে! ডক্টর গ্রান্টের ম্যানেজার তো এত রেগে গিয়েছে আমি ওর ধারেকাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। আমার দাদা সাধারণত খুবই সদয় প্রকৃতির। ঘোড়া বা গাড়ি ভাড়া নিতে চেয়েছি বলে সেও দেখি আমার উপর মহা বিরক্ত!”
“তুমি যে আগেই এসব বুঝতে পারবে সেটা অবশ্য আশা করা যায় না। তবে একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে যে এই সময় ঘাস কাটা কতটা জরুরী। তবে তুমি যেমন মনে করছ যে এখানে একটা ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করা খুব সহজ, তা কিন্তু কখনই নয়। এমনিতেই এখানে আমাদের চাষিরা সাধারণত ওগুলো ভাড়া দেয় না। আর এখন তো ফসল কাটার সময়। এইসময় ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া ওদের পক্ষে অসম্ভব।“
“তোমাদের এখানকার রীতিনীতি বুঝতে একটু সময় লাগবে আমার। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে ঠিকই বুঝে নেব। আসলে আমি তো টাকা দিলে সব পাওয়া যায়, লন্ডনের এই ধ্যানধারণা নিয়ে এসেছি, তাই এখানে গ্রামের লোকের এই স্বাধীনচেতা নিয়মকানুন দেখে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছি। তবে কালই আমার হার্পটা নিয়ে আসা হবে। হেনরি এত দয়ালু যে ও নিজেই ওর বারুচে করে নিয়ে আসবে বলেছে। মানে একটা এত সুন্দর চার চাকার ঘোড়ার গাড়িতে করে আমার হার্প আসবে, ভাবো তো কতটা সম্মানজনক হবে ব্যাপারটা!”
এডমন্ড বলল যে হার্প তার খুব প্রিয় একটা বাদ্যযন্ত্র। সে এই আশাও প্রকাশ করল যে মিস ক্রফোর্ড হয়তো খুব তাড়াতাড়ি একদিন তাকেও হার্প বাজিয়ে শোনাবে। ফ্যানি কোনোদিন হার্পের বাজনা শোনে নি। তাই ফ্যানিও হার্প বাজানো শুনতে চায়।
একথা শুনে মিস ক্রফোর্ড বলল, “আমি খুব খুশি হব আপনাদের দুজনকে হার্প বাজিয়ে শোনাতে পারলে। যতক্ষণ তোমরা শুনতে চাইবে আমি হয়তো তার থেকেও বেশি সময় ধরে তোমাদের হার্প বাজিয়ে শোনাব। আসলে আমি নিজেও সুর খুব ভালোবাসি। যে শুনছে আর যে শোনাচ্ছে দুজনেরই যদি সেই ভালো লাগাটা থাকে তাহলে যে বাজায় সে বাজিয়ে বেশি আনন্দ পায়। আচ্ছা, এবার শোনো মিস্টার বার্ট্রাম, তুমি যদি তোমার ভাইকে চিঠি লেখো তাহলে আমি অনুরোধ করছি তাকে বলবেন যে আমার হার্পটা এসে গিয়েছে। এটা নিয়ে আমার কান্নাকাটি কম তো শোনে নি সে। মনে করলে এটাও বলবে যে সে ফিরলে তাকে শোনানোর জন্য আমি সবচেয়ে মন খারাপ করা সুরগুলো রপ্ত করে রাখব। ঘোড়দৌড়ে তার ঘোড়াটা যে হেরে যাবে সেটা আমি জানি। তাই তার মনখারাপের সঙ্গে সঙ্গত করবে এমন সুরই আমি তাকে শোনাব।“
“সে আমি যখন চিঠি লিখব তখন তুমি যা বলবে তাই লিখে দেবো নাহয়। কিন্তু এখনই ওকে চিঠি লেখার কোনও কারণ আমি দেখছি না।“
“না না, সে বুঝতে পারছি। সম্ভব হলে এমন কী একবছরের জন্য গেলেও সে তোমাকে বা তুমি তাকে চিঠি লিখতে না। যেন আগে থেকে এমনিই চিঠি লেখার কথা ভাবলে মহা অনাসৃষ্টি হয়ে যাবে! তোমরা ভাইরা যে জগতের কী এক অদ্ভুত সৃষ্টি! একমাত্র ভীষণ জরুরী কিছু প্রয়োজন না হলে তোমরা কেউ কাউকে চিঠি লিখবে না। আর যখন সেরকম কিছু হয়, মানে ধরো কোনো ঘোড়া হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে, বা আত্মীয় স্বজনদের কেউ মারা গিয়েছেন, তখনও বাধ্য হয়ে যে চিঠি লিখবে সেটাও যতোটা সম্ভব কম কথায় শেষ করবে। তোমাদের, পুরুষদের এটাই ধরণ। আমি খুব ভালো করেই জানি সেটা। হেনরি, যে কীনা অন্য সব দিক থেকেই আমার জন্য একদম আদর্শ দাদা, যে আমাকে এত ভালোবাসে, আমার সঙ্গে সব রকম পরামর্শ করে, আমাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার সঙ্গে গল্প করে, সেও আমাকে আজ পর্যন্ত একটা এক পাতার চিঠি লিখে উঠতে পারল না। যখন লেখে তখনও শুধু এটুকুই থাকে, ‘প্রিয় মেরি, আমি এসে পৌঁছেছি। বাথ শহরটায় লোক গিজগিজ করছে। আর সব কিছুই আগের মতন আছে। তোমার দাদা।‘ এটাই পুরুষালি ধরণ – এক দাদার লেখা পুরো চিঠি!”
একথায় ফ্যানির নিজের দাদা উইলিয়ামের কথা মনে পড়ে গেল। সে একটু লাজুক গলায় বলল, “তবে পুরো পরিবার থেকে দূরে থাকলে ওরাও লম্বা লম্বা চিঠি লিখতে পারে।“
“ফ্যানির এক দাদা নৌবাহিনীতে আছে। সে এত ভালো চিঠি লেখে যে তোমার কথা শুনে ওর মনে হচ্ছে তুমি হয়তো একটু বেশিই দোষ দিচ্ছ আমাদের।“ এডমন্ড বলল।
“তাই নাকি? নৌবাহিনীতে? নিশ্চয়ই রাজকীয় নৌবাহিনী?”
পুরো ব্যাপারটা যদি এডমন্ডই বলত, তাহলেই ফ্যানির জন্য ভালো হতো। কিন্তু এডমন্ড এমন চুপ করে রইল যে ফ্যানিকেই নিজের মুখে নিজের দাদার কথা বলতে হলো। দাদার পেশার কথা বা বিদেশের কোথায় কোথায় থেকেছে সে কথা বলতে গিয়ে ফ্যানির চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু ওর দাদা যে কতবছর ধরে বাড়ির বাইরে সে কথা বলতে গিয়ে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না। মিস ক্রফোর্ড খুব ভদ্রতার সঙ্গে ওর দাদার দ্রুত পদোন্নতি কামনা করল।
“তুমি কি আমার মাসতুতো ভাই উইলিয়ামের ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন মার্শালের ব্যাপারে কিছু জানো? নৌবাহিনীর অনেকের সঙ্গেই নিশ্চয়ই তোমার চেনাজানা আছে?” এডমন্ড জিজ্ঞাসা করল।
মিস ক্রফোর্ড একটু অহংকারের ভঙ্গিতে বলল, “তা অ্যাডমিরালদের মধ্যে অনেককে চিনি। তবে নিচু পদের অফিসারদের বিশেষ কাউকে চিনি না। ক্যাপ্টেনরা নিশ্চয়ই খুব ভালো মানুষ, কিন্তু তাঁরা সামাজিক মর্যাদায় আমাদের সমপর্যায়ের নন। অনেক অ্যাডমিরালের গল্প আমি তোমাকে বলতে পারি। তাঁদের পতাকা, মাইনের তারতম্য, নিজেদের মধ্যে হিংসে, ঝগড়া বিবাদ – সবই জানি। তবে মোটামুটি একথা বলা যায় যে তাঁরা সবাই অবহেলিত আর তাঁদের যথেষ্ট মূল্য দেওয়া হয় না। আমার মামার বাড়িতে থাকাকালীন অনেক অ্যাডমিরালের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। রিয়ার আর ভাইস অ্যাডমিরাল, সবই দেখেছি। এখন দয়া করে যেন ভেব না যে আমি মজা করছি, আমি অনুরোধ করছি।"
এসব কথায় এডমন্ডের আবার খারাপ লাগল। সে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “কিন্তু এটা তো খুব সম্মানজনক একটা পেশা।“
“হ্যাঁ, এই পেশা শুধুমাত্র দুটো ক্ষেত্রে ভালো। যদি ভালোরকম টাকাপয়সা পাওয়া যায়, আর যদি সেই টাকাপয়সা ঠিকমতন খরচ করার বুদ্ধি থাকে। তবে এক কথায় বলতে গেলে এই পেশাটা আমার খুব একটা পছন্দের পেশা নয়। আমার কাছে এই পেশাটা কখনই খুব একটা আকর্ষণীয় বলে মনে হয় নি।“
এডমন্ড আবার হার্পের প্রসঙ্গে ফিরে গেল আর হার্প শুনতে পাবে সেই সম্ভাবনায় খুব খুশি প্রকাশ করল।
এদিকে অন্যরা তখনও বাগান সাজানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিল। যদিও এখন ডাকলে হেনরির মনোযোগ জুলিয়ার দিক থেকে সরে যাবে, তবুও মিসেস গ্রান্ট হেনরিকে না ডেকে পারলেন না। তিনি তাঁর ভাইকে উদ্দেশ করে বলেই ফেললেন, “কি হেনরি, এই বাগান সাজানো নিয়ে তোমার কিছু বলার নেই নাকি? তুমি নিজেও তো এরকম উন্নয়নমূলক কাজ করেছ। যতটুকু যা শুনেছি, তোমার এভরিংহ্যাম তো ইংল্যান্ডের সেরা জায়গাগুলোর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারে। জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো অসাধারণ। আমার চোখে তোমার এভরিংহ্যাম আগে থেকেই একেবারে নিখুঁত ছিল। কী সুন্দর জমির ঢাল আর গাছপালা। জায়গাটা আরেকবার যদি দেখতে পেতাম!”
হেনরি জবাব দিলো, “দিদি, তুমি যদি সত্যিই জায়গাটা দেখে তোমার মতামত জানাতে পারতে, তাহলে আমার জন্য তার থেকে আনন্দের আর কিছুই হতো না। কিন্তু ভয় হচ্ছে যে হয়তো তুমি একটু হতাশ হতে। তোমার এখনকার যা ধ্যানধারণা, গিয়ে দেখতে তার সঙ্গে হয়তো কিছুই মিলছে না। জায়গাটা যে কত ছোট আর সামান্য, সেটা দেখে অবাক হতে। আর সাজানোর কথা যদি বলো, তাহলে বলি, সেখানে আমার খুব বিশেষ কিছু করার ছিল না। আমার আরও বেশ কিছুদিন এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা উচিৎ ছিল।“
“তোমার বুঝি এরকম কাজ খুব পছন্দ?” জুলিয়া জানতে চাইল।
“ভীষণ পছন্দ। জায়গাটার এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে একটা বাচ্চাও বুঝবে যে ওখানে খুব বেশি কিছু করার দরকার নেই। আমিও ছোটো থেকেই জায়গাটা কী করে আরেকটু সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা যায় সেটা নিয়ে ভেবেছি। তাই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার মাস তিনেকের মধ্যেই এভরিংহ্যামকে আমি আজকের রূপে নিয়ে এসেছি। পরিকল্পনাটা আমি ওয়েস্টমিনস্টারে বসেই করেছিলাম। তারপর কেমব্রিজে গিয়ে পরিকল্পনাটার হয়তো একটু আধটু বদল করেছি মাত্র। একুশ বছর বয়স হওয়ার পরপরই আমি কাজটা পুরোটা শেষ করে ফেলি। এখন আমার তো মিস্টার রাশওয়ার্থকে একটু হিংসেই হচ্ছে। এখনও সে এই কাজ করে কতটা আনন্দ পাবে। আর এদিকে আমি তো আমার এই কাজ থেকে যতটুকু আনন্দ পাওয়া সম্ভব সবটাই খরচ করে ফেলেছি।“
জুলিয়া বলল, "যারা তাড়াতাড়ি বোঝে, তারা তাড়াতাড়িই সিদ্ধান্ত নেয় আর কাজেও নামে। তুমি তো আর চাকরি করতে কোথাও যাচ্ছ না। তাই মিস্টার রাশওয়ার্থকে হিংসে না করে তাকে বরং পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করো না কেন।"
মিসেস গ্রান্ট মনে করেন তাঁর ভাইয়ের বিচার বিবেচনার তুলনা হয় না। তাই যেই দেখলেন জুলিয়াও তাঁর মনোভাবকে সমর্থন করছে, তিনিও সঙ্গে সঙ্গে জুলিয়ার কথায় সম্পূর্ণ সমর্থন জোগালেন। তিনি এটাও বললেন যে তিনি মনে করেন এক্ষুনি সরাসরি পেশাদার কাউকে নিয়োগ করার থেকে বন্ধুবান্ধব বা নিরপেক্ষ কারোর কাছ থেকে মতামত নেওয়া বরং অনেক ভালো হবে। মিস্টার রাশওয়ার্থও খুব খুশি হয়েই মিস্টার ক্রফোর্ডকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করল। হেনরি প্রথমে নিয়ম মেনে একটু বিনয় প্রকাশ করলেও একটু পরে যেভাবে যতোটা সম্ভব সাহায্য করার ব্যাপারে রাজি হয়ে গেল। তখন মিস্টার রাশওয়ার্থ প্রস্তাব দিল মিস্টার ক্রফোর্ড যেন সোজা সোথারটনে চলে আসে আর সেখানে এক রাত থাকে।
মিসেস নরিস তাঁর দুই বোনঝির মন বুঝতে পারলেন যে তারা চায় না মিস্টার ক্রফোর্ড এখন অন্য কোথাও যায়। সেই বুঝে তিনি একটা নতুন প্রস্তাব দিলেন। “মিস্টার ক্রফোর্ড যে যেতে রাজি হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমরাই বা সঙ্গে যাই না কেন? মিস্টার রাশওয়ার্থ, তোমার জমিজায়গার উন্নয়নের ব্যাপারে আরও অনেকে আগ্রহী। তারাও হয়তো তোমার জমিজায়গার উন্নয়ন বিষয়ে মিস্টার ক্রফোর্ডের মতামত শুনতে চায়। তারপর তাদের মতামত হয়তো তোমারও কাজে আসতে পারে, তাই না? এদিকে আমি তো অনেকদিন থেকেই তোমার মায়ের সঙ্গে আরেকবার দেখা করতে চাইছি। আমার নিজের ঘোড়া না থাকার কারণেই এতদিন যাওয়া হয়নি। এখন সবাই মিলে একসঙ্গে তোমার ওখানে গেলে আমি তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে গল্প করতে পারব, আর বাকিরা ঘুরে ঘুরে পরিকল্পনা করতে পারবে। তারপর আমরা সবাই সোথারটনেই রাতের খাবার খেলাম বা এখানে ফিরে এসে একটু দেরি করে খেলাম। সে তোমার মায়ের যেমন ইচ্ছে হয়। চাঁদের আলোয় গাড়িতে করে বাড়ি ফেরাটা খুবই মনোরম একটা ব্যাপার হবে। মিস্টার ক্রফোর্ড নিশ্চয়ই আমাকে আর আমার দুই বোনঝিকে তাঁর গাড়িতে নিয়ে যাবে, আর এডমন্ড তো ঘোড়ায় চড়েই যেতে পারবে। বোন, ফ্যানি তোমার সঙ্গে বাড়িতেই থাকুক।“
লেডি বার্ট্রাম কোনও আপত্তি প্রকাশ করলেন না। যাদের যাওয়ার কথা হলো, এডমন্ড ছাড়া তারা সবাই সাগ্রহে রাজি হয়ে গেল। এডমন্ড চুপচাপ সবই শুনল, কিন্তু কিছু বলল না।