
জেন অস্টেনের এমা - ষষ্ঠ পর্ব
- 07 August, 2025
- লেখক: মধুশ্রী
৬
তার দেখানো রাস্তাটাই যে হ্যারিয়েটের জন্য ঠিক, সে নিয়ে এমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। মিস্টার এলটনকে গড়পড়তা পুরুষদের তুলনায় দেখতে কত ভালো, আগের চেয়ে সেটা আজকাল তার চোখে পড়ছিল বেশি। তেমনি মধুর তাঁর ব্যবহার। ইশারা-ইঙ্গিতে মিস্টার এলটনের হৃদয়ে হ্যারিয়েটের প্রতি প্রেম জাগিয়ে তোলা নিয়েও এমার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। উল্টোদিকে হ্যারিয়েটের মনেও যে সে প্রেমের প্রতিদানের ইচ্ছে কোনো না কোনো ভাবে জাগিয়ে তোলা যাবে, তা নিয়ে নিজের উপর এমার বিশ্বাস বেড়ে চলেছিল। মিস্টার এলটন যদি এখনো প্রেমে নাও পড়ে থাকেন, পড়তে তিনি বাধ্য। এ ব্যাপারে গভীরে ভাবনাচিন্তা করার দরকার থাকতে পারে, এমা তা মনে করত না। মিস্টার এলটন বুঝি বা কোনো কারণে হ্যারিয়েটের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে দু’টি কথা বললেন – সঙ্গে সঙ্গে এমার মনে হত, এ দু’টি হাত মিলিয়ে দেওয়ার জন্য সামান্য একটু সময় ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন নেই। হার্টফিল্ডে আসার পর থেকে হ্যারিয়েটের চলন-বলনে কেমন চমৎকার পরিবর্তন এসেছে, মিস্টার এলটন মাঝে মাঝে সেকথা তুলতেন – আর সেটাই ছিল এমার কাছে তাঁর বাড়ন্ত প্রেমের সবচাইতে স্পষ্ট প্রমাণ।
‘মিস স্মিথকে আপনি সব দিয়েছেন,’ মিস্টার এলটন বলতেন, ‘আপনার সাথে থেকে ও কেমন সহজ অথচ গরীয়সী হয়ে উঠেছে। ও যখন আপনার কাছে এসেছিল, তখনো ও সুন্দর ছিল, কিন্তু আমার মতে আপনি ওকে যা দিয়েছেন, তা ওর প্রকৃতিদত্ত রূপগুণের চেয়ে বড়।’
‘ধন্যবাদ। কিন্তু জানেন তো, ওকে শুধু একটু হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল – সামান্য এক-দুটো সামাজিক প্রথা হয়তো ওর শেখা বাকি ছিল। কিন্তু ওর স্বভাবের যে মাধুর্য, তা ওর নিজেরই। ওর শরীরে না আছে রাগ, না অহঙ্কার। আমার ভূমিকা নামমাত্র।’
‘একজন ভদ্রমহিলার কথার বিপরীতে কথা বলার অধিকার যদি আমায় দেন, তাহলে আমি বলব…’ সৌজন্যের পরাকাষ্ঠা মিস্টার এলটন বলতে যেতেন…
‘তবে হ্যাঁ, হয়তো আমি ওর ব্যক্তিত্বকে আরও স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছি, ওর ভাবনাকে এমন এক দিশা দিতে পেরেছি, যা আগে ওর অভিজ্ঞতায় ছিল না।’
‘ঠিক ঠিক, আর সেইটাই আমায় সবচেয়ে অবাক করে। এমনভাবে আরেকটি মানুষের ব্যক্তিত্বকে স্পষ্ট করে তোলা! সে কি যার-তার কাজ!’
‘এতে তো আমারই আনন্দ। ওকে ভালোবেসে যে সুখ, তা আর পাঁচজনকে ভালোবেসে পাওয়া যায় না।’
‘নিশ্চয়,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিস্টার এলটন বলতেন – যেমন মানুষ প্রেমে পড়লে বলে।
আরেকদিনের কথা। এমার মনে সেদিন হ্যারিয়েটকে ঘিরে এক ইচ্ছে জেগে উঠল। আর মিস্টার এলটনও এমার তালে তাল মিলিয়ে উঠলেন। কথাটা হচ্ছিল হ্যারিয়েটের ছবি আঁকানো নিয়ে।
‘তোমার কখনো নিজের ছবি আঁকাতে ইচ্ছে করে না, হ্যারিয়েট? কখনো কোনো শিল্পীর সামনে বসেছ?’
হ্যারিয়েট তখন ঘর থেকে বেরোবার মুখে। এক মুহূর্তের জন্য থেমে সে সহজ সারল্যে বলে উঠল, ‘মা গো! না না! কক্ষনো না!’
হ্যারিয়েট বেরোতে না বেরোতেই এমা লাফ দিয়ে উঠল,
‘ওর একটা ছবি আঁকালে একটা দুর্দান্ত জিনিস হবে, না? যত টাকা লাগবে আমি দেব। আমার তো ইচ্ছে করে, আমি নিজেই ওর একটা ছবি আঁকি। এখন ভাবতে অবাক লাগে, কিন্তু জানেন, দু’তিন বছর আগে আমার প্রতিকৃতি আঁকার দারুণ শখ জন্মেছিল। কয়েকজন বন্ধুকে বসিয়ে এঁকেওছিলাম। সবাই বলত, আমার হাত খারাপ না, দেখার চোখ আছে। কিন্তু নানা কারণে শেষে বিরক্ত হয়ে আমি আঁকা বন্ধ করে দিই। হ্যারিয়েট যদি আমার সামনে বসতে রাজি হয়, আমি খুব আনন্দ পাব।’
‘অবশ্যই আঁকুন,’ মিস্টার এলটন উত্তেজিত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আমিও খুব আনন্দ পাব! আমার অনুরোধ, আপনাকে আঁকতেই হবে। মিস উডহাউজ, আপনার বন্ধুর জন্য আপনাকে এ কাজ করতেই হবে। আমি কি জানি না আপনার আঁকার হাত কী চমৎকার! আমার কি চোখ নেই! এই ঘরের সর্বত্র আপনার আঁকা প্রকৃতি আর ফুলের ছবি ছড়িয়ে রয়েছে। আর র্যান্ডাল্সে মিস্টার ওয়েস্টনের বসার ঘরেও আপনার কিছু আঁকা রয়েছে না?’
বাঃ, ওঁর তো বেশ মনে আছে! – এমা মনে মনে ভাবল – তবে হ্যারিয়েটের প্রতিকৃতি আঁকানোর সাথে সেসবের কী সম্পর্ক! আপনি মশাই আঁকার কিচ্ছু জানেন না। আমার আঁকা নিয়ে সাতকাহন না বলে হ্যারিয়েটের জন্য কয়েক কাহন বাঁচিয়ে রাখুন দেখি! মুখে সে বলল – ‘আপনি যদি এত করে বলেন, মিস্টার এলটন, তাহলে আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। হ্যারিয়েটের মুখের রেখাগুলি এত নরম, আঁকাটা সহজ হবে না। কিন্তু তাও, ওর চোখের যে একটা বিশেষ আকৃতি, আর ঠোঁটের রেখাগুলি হয়তো আমায় আঁকতে সাহায্য করবে।’
‘ঠিক, ঠিক। চোখের আকৃতি আর ঠোঁটের রেখা – আমি জানি আপনি পারবেন। আপনাকে চেষ্টা করতেই হবে। যদি করেন, তাহলে – আপনার ভাষাতেই বলি – একটা দুর্দান্ত জিনিস হবে।’
‘কিন্তু মিস্টার এলটন, আমার মনে হয় ও বসতে রাজি হবে না। ও নিজের সবকিছু এত কমিয়ে দেখে… দেখলেন না, কীভাবে আমার কথার উত্তর দিল? যেন বলছে – ‘আমার আবার ছবি!’’
‘হ্যাঁ, দেখলামই তো। আপনি একদম ঠিক বলেছেন। আপনি কিন্তু ভাববেন না যে আমি এসব খেয়াল করি না। আমি ঠিক খেয়াল করেছি। কিন্তু…কিন্তু চেষ্টা করলে ওকে কি রাজি করানো যাবে না?’
হ্যারিয়েট অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল। সে বেচারির এমন ক্ষমতা ছিল না যে সে বাকি দু’জনের সম্মিলিত কোণঠাসা অনুরোধের মুখে সে টিকতে পারে। এমার ইচ্ছে, আঁকা তখনই শুরু করা হোক। অতএব বছর কয়েক আগে আঁকা প্রতিকৃতির বান্ডিল বেরোল, যার একটাও অবশ্য সে শুরু করে শেষ করেনি, বান্ডিল থেকে ছবি বার করে করে সে আর মিস্টার এলটন দেখতে লাগল কত বড় কাগজে হ্যারিয়েটের ছবি আঁকলে তার জন্য মানানসই হবে। কতরকমের চেষ্টা! কোনোটা ছোট্ট, কোনোটা আবক্ষ, কোথাও আবার পুরো শরীরটাই পাতা জুড়ে আঁকা হয়েছে। পেন্সিল, মোম রং, জল রং – কিছুই বাকি নেই। এমার স্বভাব, সবকিছু একসাথে করতে যাওয়া, আঁকা আর সঙ্গীতচর্চায় সে যত কম খাটুনিতে যতখানি এগোতে পেরেছিল, তা হয়তো আর পাঁচজন পারবে না। সে গাইত, বাজাত, প্রায় সবরকম মাধ্যমে ছবি আঁকতে পারত, কিন্তু কোনোকিছুতেই তার মন টিকত না। তাই যতটা ভালো হলে লোকে সত্যিকারের ভালো বলে, ততটা তার হয়ে ওঠা হয়নি। শিল্পী হিসেবে সে নিজেকে বিরাট উঁচুদরের মনে করত, তা নয়। কিন্তু অন্যের প্রশংসায় তার বিরাগ ছিল না, সে প্রশংসা তার শিল্পকীর্তির তুলনায় যতই বেখাপ্পা হোক না কেন।
বান্ডিলের প্রতিটা ছবি সত্যিই কোনো না কোনো ভাবে প্রশংসার যোগ্য। যে ছবিগুলো অনেকটাই অসমাপ্ত, বিশেষ করে সেগুলোতেই রঙের আঁচড়ের মধ্যে এমার প্রাণবন্ত সত্ত্বা বেশি করে ফুটে বেরোচ্ছিল। কিন্তু যদি এমার ছবি তেমন ভালো নাও হত, অথবা যদি তার প্রতিটি ছবিই অত্যন্ত চমৎকার হত, তবু তার দুই সঙ্গীর আনন্দ-উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ত না। তারা এমার ছবি দেখে একদম আহ্লাদে আটখানা। প্রতিকৃতি যদি মূল মানুষটির চেহারার সাথে মিলে যায়, তাহলে কে না খুশি হয়। মিস উডহাউজের ছবিগুলি ভালো বৈ মন্দ ছিল না।
‘মুখগুলো দেখে আপনাদের মনে হবে সব একইরকম,’ এমা বলল, ‘আমি আসলে শুধু আমার পরিবারের লোকেদেরকেই আঁকার সুযোগ পেয়েছিলাম তো। এটা বাবার ছবি – এটাও বাবা – কিন্তু ছবির জন্য বসতে হবে শুনে বাবা এমন ঘাবড়ে গেছিল যে, তাকে ধরে রাখতে গিয়ে আমার প্রাণান্ত। তাই এই ছবিগুলোতে বাবার সাথে তেমন মিল পাবেন না। এটা মিসেস ওয়েস্টনের, আবার একটা, আরো একটা, দেখেছেন? উফ, মিসেস ওয়েস্টনের মতো বন্ধু পাওয়া ভার। ওঁকে ছবির জন্য বসতে বললে কখনো না করতেন না। এটা আমার দিদির। ওর ছোটোখাটো মিষ্টি চেহারাটা আমার যে কী ভালো লাগে! ওকে এই ছবিটায় মোটামুটি ওর মতোই দেখাচ্ছে। ও আরেকটু বসলে আরো ভালো হত। কিন্তু ওর যা তাড়া – কখন আমি ওর চারটে বাচ্চার ছবি আঁকব তাই নিয়ে বকবক করে চলেছিল। এই যে, চারটের মধ্যে তিনটে বাচ্চার ছবি। হ্যারি, জন আর বেলা – পাতার এদিক থেকে ওদিক অবধি জুড়ে – সবকটাকে একইরকম দেখতে তো, একটাকে আঁকলেই বাকিগুলোকে আঁকার কাজ হয়ে যায়। কিন্তু দিদির এত ইচ্ছে যে আমি না করতে পারলাম না। তিন-চার বছরের বাচ্চা কি কখনো এক জায়গায় চুপ করে বসে! ওদের ছবি আঁকা তাই খুব কঠিন। খালি ওই হাবভাব আর গায়ের রংটুকুই ধরা সম্ভব, যদি না তাদের চেহারা সাধারণ বাচ্চাদের চাইতে খুব আলাদা বিদঘুটে কিছু হয়। এইটা হল চার নম্বরের ছবি – ও একদম কোলের বাচ্চা। সোফায় ঘুমোচ্ছিল, তখন এঁকেছিলাম। ওর টুপির ফুলটা দেখুন, ঠিক যেমনটি ছিল তেমনটি হয়েছে। মাথাটা যেমন হেলিয়ে শুয়েছিল, সেটাও ভালো ধরতে পেরেছি। জর্জসোনার এই ছবিটার ব্যাপারে আমার একটু গর্ব আছে। সোফার কোণটাও ভালো হয়েছে, আর এইটা হল আমার আঁকা শেষ ছবি,’ – একজন পুরুষের মাথা থেকে পা অবধি ছবি – যদিও আকারে ছোট – ‘শেষ ছবি আর সবচাইতে ভালো ছবি – মিস্টার জন নাইটলি – আমার জামাইবাবু – এটা খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে হয়েছিল, দেখতেও ওঁর মতোই হয়েছিল (মিসেস ওয়েস্টন আর আমার তো অন্তত তাই মনে হয়) – বরং ওর চাইতেও দেখতে যেন একটু বেশি ভালো হয়েছিল – তবে সেটা ওই ডানদিকের রেখাগুলোর জন্য – যাই হোক, এত কাণ্ডের পর ইসাবেলা এসে বলে কিনা – ‘হ্যাঁ ঠিকই আছে, তবে ওঁকে আরও একটু ভালো করে আঁকা যেত।’ আরে মিস্টার নাইটলিকে ছবির জন্য বসাতে যে আমাদের কত কসরত করতে হয়েছিল কী বলব – যেন বসে আমাদের উদ্ধার করে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আমার আর ছবিটা শেষ করতে ইচ্ছেই হল না – ওঁকে আঁকতে বসাটাই যেন অন্যায়! এবার থেকে সকালবেলা ওঁর ব্রুন্সউইক স্কোয়ারের বাড়িতে যত লোক দেখা করতে আসবে, তাদের কাছে জনে জনে ক্ষমা চাইতে হবে – কেন আমার আঁকা ছবিটা ঠিক ওঁর মতো দেখতে হয়েছে। এই গোলমালের ঠেলায় আমি প্রতিকৃতি আঁকাই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু হ্যারিয়েটের জন্য – আসলে আমার নিজের জন্যই – আর এক্ষেত্রে যেহেতু কোনো স্বামী-স্ত্রী-জনিত জটিলতার জায়গা নেই – আমি আবার আঁকতে চাই।’
মিস্টার এলটনকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এই সিদ্ধান্তে শুধু আনন্দিত নন, মুগ্ধ। তিনি এমন বারবার বলতে লাগলেন, ‘ঠিক, ঠিক। স্বামী-স্ত্রী-জনিত জটিলতা মোটেই নেই,’ যে এমার মনে হল তার বোধহয় এখনই এ দু’টি প্রাণীকে একা ছেড়ে দিয়ে অন্তরালে সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু এদিকে তার আঁকার ইচ্ছেও ষোল আনা।
প্রতিকৃতি কত বড় হবে আর কোন মাধ্যমে তা আঁকা হবে, সেসব ঠিক করতে এমার বেশি সময় লাগল না। জলরঙে আঁকা পূর্ণাবয়ব ছবি – যেমন মিস্টার নাইটলির ছবিটা ছিল। আর সেটাকে রাখা হবে ফায়ারপ্লেসের উপরে, ম্যান্টেলপীসের একটি বিশেষ জায়গায়।
আঁকা শুরু হল। হ্যারিয়েট লজ্জায় এমন হেসে গড়িয়ে পড়ছিল যে তার পক্ষে লম্বা সময় ধরে মুখের একইরকম ভাব ধরে রাখা সম্ভব হবে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। শিল্পীর চোখ অবশ্য তারই মধ্যে এক কিশোরীর উচ্ছলতা খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ হচ্ছিল। কিন্তু উল্টোদিকে মিস্টার এলটন এমার পিছনে বসে এমন ছটফট করছিলেন, আর কাগজে প্রতিটা আঁচড় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন চোখ গোল গোল করে দেখছিলেন যে এমার পক্ষে আঁকা দায় হয়ে উঠল। অবশ্য মানতেই হবে যে, তিনি বসার জন্য এমন এক জায়গা বেছে নিয়েছিলেন যাতে তিনি তাকিয়ে থাকলেও এমা আর হ্যারিয়েটের কোনো অসুবিধা না হয়। তাসত্ত্বেও অসুবিধা যথেষ্টই হচ্ছিল। শেষে এমার মাথায় এল, তাঁকে কিছু একটা পড়তে দিলে হয়তো এ বিপত্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
তিনি যদি ওদের কিছু একটা পড়ে শোনান, তাহলে এমনিতেও ওদের সময়টা ভালো কাটবে। এমার সমস্যাও দূর হবে আর মিস স্মিথের ছটফটানিও কমবে।
মিস্টার এলটনের তাতে কোনো আপত্তিই ছিল না। অতএব হ্যারিয়েট শান্ত হয়ে তাঁর পড়া শুনতে লাগল, আর এমাও অবশেষে তার কাজে মন বসাতে পারল। অথচ মিস্টার এলটন যদি একদম ছবির দিকে মন না দেন, সেটাও যে ঠিক প্রেমিকসুলভ নয়। তাই দেখা গেল, যখনই এমা পেনসিল থামাচ্ছে, তখনই তিনি লাফ দিয়ে এসে ছবিটা কতদূর হল তাই দেখে তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করে চলেছেন। এমন ভক্তের উপর রাগ করা চলে না, ছবিটা হ্যারিয়েটের মতো দেখতে শুরু করার অনেক আগে থেকেই তিনি বলতে শুরু করলেন – ‘এ যে অবিকল হ্যারিয়েট!’ – ফলে তাঁর শিল্পবোধের উপর এমার বিশেষ শ্রদ্ধা জন্মাচ্ছিল না, কিন্তু তাঁর সৌজন্যের, স্নেহের তুলনা ছিল না।
সব মিলিয়ে সেদিনের আঁকা ভালোভাবে মিটে গেল। প্রথম দিনের তুলনায় ভালোই হয়েছিল বলতে হবে, তাই এমা কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বেশ উৎসাহ বোধ করছিল। তার ভাগ্য ভালো, ছবিটা হ্যারিয়েটের মতোই দেখতে হচ্ছিল। এমার ইচ্ছে, ছবিটা যেন ছবির মডেলের চাইতে আর একটুখানি বেশি সুন্দর হয় – দু’আঙুল বেশি লম্বা, মুখটা আরো একটু সুন্দর, ছবিতে যেন কোনো খুঁত না থাকে, আর জায়গামতো রাখার পরে যেন শিল্পী আর মডেল যেন একইভাবে প্রশংসিত হয়। একজনের রূপ, আরেকজনের হাতযশ, আর তাদের বন্ধুত্ব – এই তিনের মোহনা হয়ে উঠবে এ ছবি। তারপর গল্প যে সেখানেই শেষ নয়, সে তো মিস্টার এলটনের ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
পরেরদিন হ্যারিয়েট আবার জায়গামতো এসে বসল, মিস্টার এলটনও তাঁর দায়িত্ব অনুযায়ী জোরে জোরে পড়তে শুরু করলেন।
‘কী মজা! আপনি যেন আমাদের নিজের লোক!’
সেই একই সৌজন্য বিনিময়, মিষ্টি মিষ্টি কথা জারি রইল ছবি আঁকার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ছবিটা তাড়াতাড়িই আঁকা হয়ে গেল। সবাই খুশি। যে দেখল, সেই ছবিটার প্রশংসা করল, কিন্তু মিস্টার এলটনের কাছে ছবিটা অমূল্য – সামান্যতম বিরূপ মন্তব্য শুনতেও তিনি রাজি নন।
‘খুব ভালো হয়েছে মা,’ মিস্টার উডহাউজ বললেন, ‘চমৎকার আঁকা। ঠিক যেমন তোমার সব ছবিই চমৎকার হয়! তোমার চেয়ে ভালো আঁকে এমন আর কাউকে আমি চিনি না। আমার একটাই আপত্তির জায়গা – ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে মিস স্মিথ বাড়ির বাইরে কোথাও বসে আছে, অথচ ওর কাঁধে একটা পাতলা চাদর মাত্র। যদি ঠান্ডা লেগে যায়!’
‘কিন্ত বাবা, এটা তো গরমকালের কথা ভেবে আঁকা! গ্রীষ্মের একটি সুন্দর, আরামদায়ক দিন। গাছগুলোকে দেখছ না?’
‘কিন্তু মা, বাড়ির বাইরে বেশিক্ষণ বসে থাকা কি ভালো?’
‘আপনি যাই বলুন স্যার,’ মিস্টার এলটন বলে উঠলেন, ‘আমার মতে মিস স্মিথকে বাড়ির বাইরে বসানোর সিদ্ধান্তটা খুবই যথাযথ। ওর ফলে ছবিটা কেমন খুশি-খুশি হয়ে উঠেছে, দেখছেন না? আর ওই গাছটা, কী অপূর্ব প্রাণবন্ত! অন্য কোথাও বসালে ওঁর চরিত্রটা কি অমন ভাবে ফুটে উঠতে পারত? মিস স্মিথের সারল্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্য সব মিলিয়ে এর চেয়ে ভালো প্রেক্ষাপট ভাবাই যেত না। আমি তো চোখ ফেরাতে পারছি না। এমন অবিকল প্রতিকৃতি আমি কখনো দেখিনি।’
এর পরের পর্ব – ছবিটাকে বাঁধানো। সমস্যা দেখা দিল – ছবিটাকে সরাসরি বাঁধাতে হবে, আর লন্ডন ছাড়া আর কোথাও সেটা করা সম্ভব না। আর কাজটা করাতে হবে এমন কাউকে দিয়ে যে বোকাহাবা নয়, যার উপর ভরসা করা যায়। এদিকে ইসাবেলা, যাকে দিয়ে সাধারণত এধরনের কাজ করানো হয়, তার কাছে এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করার উপায় নেই, কারণ এখন ডিসেম্বর মাস। মিস্টার উডহাউজ কখনোই মেনে নেবেন না তাঁর মেয়ে ডিসেম্বরের কুয়াশায় লন্ডনের রাস্তায় ঘুরে বেড়াক। এক্ষেত্রেও, সমস্যার কথা জানামাত্র মিস্টার এলটন বীরের মতো তা দূর করতে এগিয়ে এলেন। ‘ওঁকে কাজটা করতে দিলে ওঁর কী ভালোই না লাগবে। লন্ডন যাওয়া এমন কী কাজ। কিন্তু এই বিশেষ কাজটার অন্তর্নিহিত রস তাঁকে যে আনন্দ দেবে, তার মূল্য অসীম!’
‘বাবা রে বাবা, উনি এত ভালো কেন!’ এমা আর পারে না, মিস্টার এলটনকে আর ঝুলিয়ে না রেখে এক্ষুনি ওঁর মনোবাসনা পূর্ণ করে ফেলতে হবে, এমনিতেই উনি বহুবার আর্জি জানিয়ে ফেলেছেন যে কাজটা উনিই করবেন। তাই হোক। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কথাবার্তা মিটে গেল।
মিস্টার এলটন ছবিটা নিয়ে লন্ডন যাবেন, ফ্রেম পছন্দ করবেন এবং কীভাবে বাঁধাতে হবে সেটা দোকানে বুঝিয়ে দেবেন। এমা ঠিক করল ছবিটা সে ভালোভাবে গুছিয়ে ব্যাগে ভরে দেবে, যাতে যাত্রাপথে ওটার কোনো ক্ষতি না হয়। অবশ্য মিস্টার এলটনও এ বিষয়ে যথেষ্ট আতঙ্কে আছেন, ফলে চিন্তার কিছু নেই।
তাঁর হাতে যখন শেষমেশ ছবিটা দেওয়া হল – ‘অমূল্য!’ তিনি ফিসফিস করে বলে উঠলেন।
‘লোকটি এত নরমসরম, এর দ্বারা কি প্রেম হবে?’ এমা ভাবল, ‘অবশ্য আমি তার কী জানি, প্রেমও তো একশো রকমের হয়। উনি যে একজন পাক্কা ভদ্রযুবক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হ্যারিয়েটের ঠিক যেমন পাত্র চাই, তেমনই, ‘অবিকল!’’ মিস্টার এলটনের লব্জ নকল করে এমা ভাবে, ‘অবশ্য উনি যেমন সারাক্ষণ লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, দুঃখী দুঃখী মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর অপেক্ষা করছেন কখন ওঁকে মিষ্টি করে একটা কথা বলা হবে, সেটা সহ্য করা কঠিন। যাকগে, আমি তো দু’নম্বর মাত্র। হ্যারিয়েট ওঁর এক নম্বর, এসব হ্যারিয়েট বুঝে নেবে’খন।