হান কাং এর হিউম্যান অ্যাক্টস- বাংলা তরজমা - ২

ক্লাসঘরের বেঞ্চিগুলো সামনে থেকে পিছনে ধাপে ধাপে উচ্চতা অনুযায়ী সাজানো – তোমার জায়গা সবসময়েই একেবারে সামনেরটায় – অর্থাৎ সবচেয়ে খর্বকায় মানুষ তুমি। মার্চ মাসে যখন তুমি মিডল স্কুলের তৃতীয় বর্ষের পড়া শুরু করলে, তখন তুমি সদ্য সদ্য কৈশোরে পা রেখেছ – গলার স্বর একটু ভেঙেছে, অল্পস্বল্প বাড়বৃদ্ধিও হয়েছে, যদিও তখনও বয়সের তুলনায় তোমাকে বাচ্চাই দেখায়। জিন-সু তার কাজ নিয়ে ব্রিফিং রুমেই ব্যস্ত থাকত বেশীরভাগ সময়ে – প্রথমবার তোমাকে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিল সে।

“তুমি তো ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, না? এটা তোমার জায়গা নয় হে” বড়বড় ভ্রু-পল্লব আর ভারী চোখের পাতায় জিন-সু কে প্রায় নারীসুলভ দেখাচ্ছিল। সিওলের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সে পড়াশোনা করে তা তখনকার মত বন্ধ থাকায় সে গোয়াংজু তে এসে থাকছিল কিছুদিন।

“না”, তুমি বলেছিলে, “আমি থার্ড ইয়ার। আর এখানকার কাজ নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই।“

এতে অবশ্য বিরাট বাহাদুরির কিছু ছিল না; সত্যি বলতে কী, এখানে যে সমস্ত কাজ ছিল তার কোনোটাই এমন কিছু কঠিন কিছু ছিল না আদৌ। সিওন-জু আর ইউন-সুক ইতিমধ্যেই আসল ভারি কাজগুলো সব সেরেই ফেলেছিল – যেমন প্লাইউড বা স্টাইরোফোমের বোর্ডগুলিকে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে ফেলা, তারপর মৃতদেহগুলিকে তুলে সেই বোর্ডের ওপর রাখা। দেহগুলির মুখ এবং ঘাড় জল দিয়ে পরিষ্কার করে, একটু চিরুনি চালিয়ে ঠিকঠাক করে দুর্গন্ধ আটকাতে শরীরগুলোকে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখার কাজও তারাই সেরে ফেলেছিল। ইতিমধ্যে তুমি একটা লেজার খাতায় দেহগুলির লিঙ্গ পরিচয়, সম্ভাব্য বয়স, কী কী জামাকাপড় পড়েছিল, কোন ব্র্যান্ডের জুতো পরেছিল, এসব লিখে ফেলেছ এবং প্রত্যেকটা দেহ একেকটা নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করেছ। তারপর তুমি সেই নম্বরটা একটা সাদা কাগজে লিখে সংশ্লিষ্ট দেহটির বুকের ওপর সেটা পিন দিয়ে আটকে দিয়েছ, তারপর শরীরটাকে কাঁধ অবধি সাদা চাদরে ঢেকে দিয়েছ। তারপর ইউন-সুক আর সিওন-জু এর সাহায্যে সেই দেহগুলিকে দেওয়ালের দিকে নিয়ে গিয়ে সাজিয়ে রেখেছ। জিন-সু, যাকে দেখে মনে হয় একজন পাকাপাকিভাবে ব্যতিব্যস্ত মানুষ, দিনের মধ্যে বারবার তোমার কাছে ছুটে আসে, তোমার লেজারে তোলা বিবরণগুলি নিজের পোস্টারে লিখে নিয়ে বিল্ডিং এর মূল প্রবেশপথে টাঙিয়ে রাখার জন্য।

যারাই এখানে কাউকে খুঁজতে আসছে, প্রত্যেকেই এই পোস্টারগুলি হয় নিজেরাই দেখতে পেয়েছে বা কারুর কাছে এদের কথা শুনেছে। যখন কেউ নিজের লোককে ঠিকঠাক চিহ্নিত করতে পারছে, তুমি সসম্ভ্রমে একটু দূরে সরে দাঁড়াচ্ছ, তাকে কাঁদবার, শোকপ্রকাশ করার সময় দিচ্ছ। মৃতদেহগুলিকে যেহেতু কোনোরকম ব্যবস্থা ছাড়াই কোনোমতে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে, তাই শোকগ্রস্ত মানুষগুলিকে নাকে দেবার জন্য তুলোও দিতে হচ্ছে, আর যতটা সম্ভব নতুন কাপড়ে দেহগুলিকে মুড়ে দিতে হচ্ছে। এভাবে কাপড়ে মুড়ে ফেলার পর তাদের কফিনে ঢোকানো হলে সেই দেহগুলি যাতে ঠিকঠাকভাবে জিমে নিয়ে যাওয়া হয় সেটা দেখা তোমারই দায়িত্ব – এবং তোমার লেজারে সেই রেকর্ড তুলে রাখার কাজটাও।

এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা অংশ তোমার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না – শোকগ্রস্ত পরিবারের লোকগুলির সামনে যে সংক্ষিপ্ত পারলৌকিক অনুষ্ঠানটা হয়, সেখানে এই মৃতদেহগুলির সামনে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়, জাতীয় পতাকা তেগুক্কি দিয়ে কফিনগুলি ঢেকে দেওয়া হয় – কেন? যে মানুষগুলো আমারই দেশের সেনাবাহিনীর হাতে মারা গেল, তাদের জন্য জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে কেন? কেন তাদের কফিন ঢেকে রাখা হবে তেগুক্কি দিয়ে? এই জাতিই কি ওদের খুন করেনি?

তোমার চিন্তাটা যখন সন্তর্পণে ইউন-সুককে তুমি জানালে, তার গোল গোল চোখগুলো যেন আরও বড় বড় হয়ে গেল।

“কিন্তু ঐ জেনারেলরা তো বিদ্রোহী, বে-আইনীভাবে ওরা ক্ষমতা দখল করেছে। দেখোনি, প্রকাশ্য দিবালোকে কিভাবে মানুষজনকে বেয়নেট দিয়ে মারছিল, গুলি পর্যন্ত করছিল? সাধারণ সৈনিকেরা তো শুধু তাদের ঊর্দ্ধতনদের আদেশ পালন করছিল। ওদেরকে তুমি কেমনভাবে আমাদের জাতি বলতে পারো?”

এই উত্তর শুনে তুমি আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়লে – যেন, তুমি যে প্রশ্নটা করেছিলে, তার বদলে অন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল তোমাকে। সেদিন বিকেলটা বেশ সুন্দর, সুলক্ষ্মণযুক্ত লাগছিল এমনিতে, বারান্দার বিভিন্ন জায়গায় একই সাথে অনেকগুলো শরীর আবরিত করার অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছিল। জাতীয় সঙ্গীতের সুরটা যেন গোল গোল করে নিজেরই প্রতিধ্বনি করে যাচ্ছিল – একটার কথা আরেকটার ওপরে পরে ধাক্কাধাক্কি চলছিল, আর পিছনে একটানা কারুর না কারুর কান্না যেন নেপথ্যসঙ্গীতের মত বেজে যাচ্ছিল। তুমি ক্ষীণ শ্বাস নিতে নিতে এই অস্পষ্ট হট্টগোল শুনে যাচ্ছিলে। যেন এটা শুনতে শুনতেই শেষ পর্যন্ত জাতি আসলে কী বস্তু সেটা তুমি বুঝে ফেলবে।

পরেরদিন সকালে তুমি আর মেয়েদুটি মিলে একদম পচে যাওয়া শবগুলিকে ধরাধরি করে আঞ্চলিক অফিসের পিছনের উঠোনে নিয়ে গেলে। এত নতুন নতুন দেহ আসছিল যে ঘরের ভিতরে আর রাখার জায়গাও হচ্ছিল না। সদাব্যস্ত জিন-সু যথারীতি ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে জানতে চাইল, বৃষ্টি হলে তুমি শবগুলিকে কোথায় সরানোর কথা ভাবছ।

সে একবার বারান্দাটার দিকে দেখল – সেখানে সারে সারে শবগুলি দেওয়ালের সাথে ঠেসে রাখা। সিওন-জু তার মাস্কটা মুখ থেকে খুলল।

“এই জায়গাটা বড্ডই সরু”, সে বলল, “এখানে আর কোনোরকম জায়গাই নেই। সন্ধের মধ্যে আরও বেশ কিছু শব চলে আসবে বলেই মনে হয় – তখন কী করব? এদেরকে পৌরসভার জিমে নিয়ে গেলে কেমন হয়? ওখানে তো অনেকটা বড় জায়গা আছে না?”

এক ঘন্টাও পেরোনোর আগেই জিন সু চারজন লোক পাঠিয়ে দিল। এরা সম্ভবতঃ কোথাও পাহারা দিচ্ছিল, কারণ প্রত্যেকেরই কাঁধ থেকে রাইফেল ঝুলছিল আর মাথায় দাঙ্গা-পুলিশদের ফেলে যাওয়া পুরো মুখ ঢাকা হেলমেট পরা ছিল। তারা যখন শবগুলিকে ট্রাকে তুলছিল, তুমি এবং মহিলা দুজন অন্যান্য খুঁটিনাটি জিনিষগুলি গুছিয়ে নিচ্ছিলে। টড়াকের পিছন পিছন সেই শান্ত স্নিগ্ধ সকালে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তুমিও জিমে গিয়ে পৌঁছালে। এখনো কৈশোর পার না হওয়া জিঙ্কোগাছগুলির নীচে দিয়ে যাবার সময়ে অভ্যাসবশেই তুমি লাফিয়ে ডালগুলি ছুঁতে চেষ্টা করেছিলে – সবচেয়ে নীচের ডাল-পাতাগুলি তোমার মুখ মাথা ছুঁয়ে গেছিল।

ইউন-সুক ছিল সবার আগে – সেই প্রথম জিমে ঢুকল। তুমি যখন ঘরের ভিতর ঢুকলে, ঘরভর্তি সারি সারি কফিনের মধ্যে ওকে তখন যেন অনেকটা ছোট মনে হচ্ছিল। ওর হাতের গ্লাভসগুলি রক্তের দাগে কালচে দেখাচ্ছিল। সিওন-জু আমার পিছন পিছন ঘরে ঢুকে একটা বড় রুমাল দিয়ে নিজের কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলি ঢেকে বেঁধে নিল।

“সবকজনকেই এখানে নিয়ে আসবে সেটা আমি আগে বুঝিনি – ইশ, এখানে এভাবে একসাথে সবগুলো দেখে মনে হচ্ছে, কত বেশী – হায় ভগবান”

তুমি শোকগ্রস্ত আত্মীয়স্বজনদের দেখছিলে – কার্যত তাঁরা একে অপরের পিঠের পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটু মুড়ে বসেছিলেন। সব পরিবারই তাদের সংশ্লিষ্ট কফিনগুলির ওপর একটা করে মৃতের ছবি দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। কয়েকটা কফিনের মাথার কাছে এমনকি দুয়েকটা কাচের ফান্টার বোতলও পাশাপাশি রাখা ছিল। একটা বোতলে ফুলের তোড়া, আরেকটায় মোমবাতি গোঁজা।

সেদিন সন্ধেবেলা যখন জিন-সুকে তুমি জিজ্ঞেস করলে সে কোনোভাবে এক বাক্স মোমবাতি জোগাড় করতে পারবে কি না। সে উৎসুক ভাবেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

“মোমবাতি – ঠিক। তাহলে এই পচা গন্ধটাও অনেকটাই কমবে।“

যখনই তুমি জিন-সু কে কোনো প্রয়োজনের কথা বলেছ, সে সুতির কাপড় হোক কিংবা কাঠের কফিন, অথবা ছেঁড়া কাগজ বা জাতীয় পতাকা – সে তার নোটবুকে সেটা টুকে নেয়, তারপর সেইদিনের মধ্যেই কোথা থেকে কে জানে, জিনিষটা এসে হাজির হয়ে যায়। সিওন-জু কে ও বলেছিল একবার যে ও প্রতিদিন সকালে ডেয়িং অথবা ইয়াংডং বাজারে যায় – আর সেখানে যদি কোনো জিনিস না পাওয়া যায়, তবে সে চলে যায় কখনো কাঠের কাজ করা লোকেদের দোকানে, কখনো সৎকার সংক্রান্ত জিনিষের দোকানে, আবার কখনো বা পর্দার কারবারীদের কাছে – সারা শহর জুড়ে। বিভিন্ন মিটিং থেকে অনুদান হিসাবে সংগ্রহ করা টাকার অনেকটাই তখনো হাতেই ছিল, তাছাড়া ও যখন গিয়ে বলত যে আমি আঞ্চলিক অফিসের পক্ষ থেকে আসছি, দোকানিরা অনেকেই দাম থেকে অনেকটাই ছাড় দিয়ে জিনিষ দিয়ে দিত তাকে, কখনো কখনো এমনকি দাম নিতেও অস্বীকার করত। অতএব টাকাপয়সাটা তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু এখন গোটা শহরে আর কফিন পাওয়া যাচ্ছিল না – তাই জিন-সু যেখানে যত প্লাইউড পেয়েছে কিনে নিয়ে নতুন এক ঝাঁক কফিন বানাতে দিয়েছে ছুতোর মিস্ত্রীদের।

সেদিন সকালে জিন-সু প্রচুর দেশলাই বাক্স আর পাঁচ বাক্স মোমবাতি এনে হাজির করল – প্রতিটা বাক্সে পঞ্চাশটি করে। তুমি যেখানে যত মোমবাতি লাগানোর মত কাচের পানিয়ের বোতল পেলে নিয়ে এসে তাদের ওপর মোম লাগিয়ে ঘরের প্রতিটা কোনায় সেগুলো জ্বালিয়ে দিলে। আত্মীয়রা তোমার টেবিলের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিলেন, তুমি একটা একটা করে মোমবাতি বোতলে আটকে দিচ্ছিলে, তাঁরা সেগুলি নিয়ে গিয়ে নিজ নিজ প্রিয়জনের কফিনের মাথার কাছে রাখছিলেন এক এক করে। সবগুলি কফিনে একাধিকবার দেবার মত যথেষ্ট মোম ছিল – এমনকি যে দেহগুলি এখনো চিহ্নিত হয়নি, বা যাদের দেখাশোনা করার মত কেউ নেই, সেগুলির জন্যেও।

প্রতিদিনই নতুন নতুন কফিন আসছিল জিমে – সেখানে একটা চাতালে একসাথে অনেকের অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে হয়েছিল। এই নবাগ শবগুলি ছিল সেইসব মানুষের, যাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের সন্তপ্ত পরিজনেরা যখন হাতে টানা গাড়িতে তাঁদের দেহগুলি নিয়ে আসছিলেন, ওঁদের চোখমুখ ওরকম চকচক করছিল – অশ্রুতে, নাকি ঘামে, বোঝা যাচ্ছিল না। নতুন শবগুলিকে জায়গা করে দিতে পুরনো কফিনগুলি তুমি ঠেলে ঠেলে আরো কাছাকাছি আনছিলে।

সন্ধের দিকে সেনাবাহিনীর সাথে সঙ্ঘর্ষে যারা শহরতলীর দিকে মারা গেছেন, তাঁদের দেহগুলি আনা হচ্ছিল। এঁদের কেউ কেউ তৎক্ষণাৎ গুলি খেয়ে মরেছেন, কাউকে আবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। অনেকেই বেশ দীর্ঘ যুদ্ধের পরে তবেই প্রাণত্যাগ করেছেন – তাঁদের কারো কারো মুখগুলো খুব অস্বস্তিকর রকমের জীবন্ত লাগছিল।  ইউন-সুক একটা মৃতদেহের পেট চিরে বেরিয়ে আসা নাড়িভুড়িগুলি ধরে ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মাঝপথে কাজ থামিয়ে একছুটে বাইরে অডিটোরিয়ামের দিকে গেছিল বমি করতে। সেওন-জু এর ছিল নাক দিয়ে রক্ত পড়ার সমস্যা – তাকে প্রায়ই দেখা যেত হাতের চেটোর উল্টোপিঠ দিয়ে নাকের ওপর মাস্কটাকে চেপে ধরে আছে। 

এই মেয়েদুটি যা করে যাচ্ছিল, তার সাথে তুলনা করলে তোমার কাজটা তেমন কিছুই বলা যায় না। আঞ্চলিক অফিসে তুমি যা যা করছিলে, এখানেও তাইই – তারিখ, সময়, জামাকাপড় আর শারিরীক বর্ণনাগুলি লেজার খাতায় রেকর্ড করে রাখার কাজ। কাপড়গুলি ইতিমধ্যেই ঠিক মাপমতন কাটা হয়ে গেছিল, প্রতিটি কাপড়ের এক কোনে একটা করে কাগজের টুকরো লাগানো ছিল – যাতে নম্বর ফেলা হয়ে গেলেই সাথে সাথে পিন দিয়ে সেই নম্বরটি শবদেহটির গায়ে লাগিয়ে দেওয়া যায়। আরও বেশী জায়গার প্রয়োজন ক্রমশঃ বাড়ছিল বলে তুমি অসনাক্ত দেহগুলিকে আরও কাছাকাছি করে দেওয়ালের দিকে ঠেলছিলে – আর তার পেছনে কফিনগুলিকেও। এক রাতে যখন একসাথে অনেকগুলো শব আসতে লেগেছিল, সেদিন আর সেগুলিকে ঠিকঠাক ক্রমানুসারে সাজানোর মত না ছিল জায়গা, না ছিল সময়, অগত্যা কফিনগুলিকে কোনোমতে একটার ওওর আরেকটা তুলে দিতে হচ্ছিল, একটার সাথে আরেকটা সাঁটিয়ে। সেই রাতে জিম হলের সেই শবদেহগুলির দিকে তাকিয়ে তোমার মনে হয়েছিল, এটা যেন একটা প্রথার মতন – এই শবদেহের গণমিছিল যেন আগে থেকেই ঠিক হয়েছিল – আর এখানে তাদের ভূমিকা ছিল ওই ভয়ঙ্কর পচা গন্ধটা উৎপাদন করা। এই মৃতের সভায় তুমি তোমার লেজার খাতাটা বগলে চেপে দ্রুত এবং নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে।

এবার সবটা ঘেঁটে যাবেই যাবে ভাবতে ভাবতে তুমি সেই আধো-অন্ধকার জিমন্যাশিয়ামের দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে। তুমি পিছনের উঠোনটার দিকে এগোচ্ছিলে – ওই ঠান্ডা পরিস্কার হাওয়াটা আরও একটু বুকে টেনে নেবার আশা নিয়ে – কিন্তু বিল্ডিং এর কোনায় এসে তুমি থেমে গেলে। নিজের চৌকি ছেড়ে বেশীদূর যাওয়া ঠিক হবে কি না ভাবছিলে তুমি। ওদিকে এখন বক্তার স্বর বদলে একটি যুবক ছেলের গলা শোনা যাচ্ছিল।

“আমরা এমনি এমনিই আমাদের অস্ত্র সমর্পন করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করতে পারিনা। সবার আগে আমাদের স্বজনদের মৃতদেহগুলি ওদের ফিরিয়ে দিতে হবে আমাদের কাছে। আর যে শয়ে শয়ে বন্ধুদের ওরা জেলে বন্দী করে রেখেছে, তাদেরকেও মুক্তি দিতে হবে। এবং তদুপরি এখানে যা ঘটেছে, সেই সত্যটা ওদেরকে দিয়ে স্বীকার করাতে হবে – যাতে অবশিষ্ট দেশের কাছে আমাদের হৃত সম্মান আমরা ফিরে পাই। তারপরে ওদের অস্ত্রগুলি ফিরিয়ে দিতে আমাদের আর কোনো বাধা থাকবে না – থাকবে কি? আপনারা কী বলেন?”

তুমি বুঝতে পারছিলে, মানুষের হাততালি আর সমর্থনের শব্দ আগের থেকে অনেক কমে এসেছে। সৈন্যরা চলে যাবার একদিন পরে যে সভাটা হয়েছি;ল, সেটার কথা তোমার মনে পড়ছিল। সেদিন এত বেশী লোক হয়েছিল যে আঞ্চলিক অফিসের ছাদে, ঘড়ির টাওয়ারে সর্বত্র লোকে ভিড় জমিয়েছিল। রাস্তাটা একটা পাদুক বোর্ডের মত সাজানো হয়েছিল, কোনোরকম গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আর বাকি জায়গা জুড়ে ছিল বড় বড় বিল্ডিং গুলি। প্রায় এক লক্ষেরও বেশী মানুষ সেইসব রাস্তা দিয়ে বিশাল সব ঢেউয়ের মত এসে জমায়েত হয়েছিল সেদিন। তারা কন্ঠ মিলিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিল সবাই, সমবেত কন্ঠস্বর যেন এক বিশাল মিনারের মত আকাশে ঠেলে উঠছিল – প্রতিটি কন্ঠস্বর যেন তার একেকটি ধাপ, একেকটি কাহিনী। তাদের হাততালির শব্দগুলি যেন মনে হচ্ছিল হাজার হাজার আতশবাজী কেউ একসাথে ফাটিয়ে দিয়েছে। গতকাল সকালে তুমি জিন-সু আর সেওন-জু এর আলোচনা শুনছিলে – কী হতে পারে তাই নিয়ে। খুব গম্ভীর মুখে জিন-সু বলছিল, যে গুজব রটেছে নাকি, সেদিনের জমায়েতে যারা উপস্থিত ছিল, সৈন্যরা ফিরে এসে তাদের সকলকে শেষ করে দেবে। পরের জমায়েতগুলি তাই খুব সন্তর্পনে ছোট আকারে করা হচ্ছিল। “যদি ওই সৈন্যদেরকে আমরা আবার শহরে ঢোকার থেকে আটকাতে চাই, আমাদের লোক বাড়ানো দরকার – কমানো নয়। মতিগতি আমার মোটেই ভালো ঠেকছে না – প্রতিদিন আরও আরও কফিন এসে ঢুকছে এখানে – বাড়ির বাইরে যেতেও লোকজন এখন দুইবার ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।“

“রক্ত কি যথেষ্টই ঝরেনি? এত রক্ত এত সহজেই স্মৃতির আড়ালে চলে যাবে? ব্যর্থ হয়ে যাবে? যেসব আত্মারা আমাদের ছেড়ে গেছেন, তারা কিন্তু নজর রাখছেন – চোখ মেলে তাঁরা দেখছেন”

বক্তৃতাপ্রদানকারী মানুষটির গলা শেষের দিকে ভেঙে আসে – “রক্ত” শব্দটার বারংবার উচ্চারণে তোমার বুকের মধ্যে একটা চাপ বেধে আসে – মুখটা হাঁ করে আরও একবার গভীর নিশ্বাস নিলে তুমি।

আত্মার তো কোনো শরীর নেইতাহলে সে আমাদের কেমন করে দেখবে?

গত শীতে তোমার দিদিমার মৃত্যুর কথা মনে পড়ে যায় তোমার। সামান্য ঠান্ডা লাগা থেকে শুরু হয়েছিল, হয়ে গেল নিউমোনিয়ায় – হাসপাতালে ভর্তী করা হল ওঁকে। প্রায় পক্ষকাল সেখানে ভর্তী থাকার পর একদিন তুমি তোমার মায়ের সাথে তাঁকে দেখতে গেছিলে – সেটা ছিল একটা শনিবারের সকাল। বার্ষিক পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে – সেই স্বস্তি তোমার গায়ে নরম রোদের মত লেপ্টে ছিল। কিন্তু তারপরেই সাবধান হবার কোনো সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ তাঁর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। মা তোমার দাদার সাথে যোগাযোগ করে তাকে যত শিগগির সম্ভব আসতে বললেন – কিন্তু যানযটের কবল থেকে বেরিয়ে সে এসে পৌঁছানোর আগেই দিদিমা তাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

ছোটবেলায় যখনই ওঁর বাড়ি বেড়াতে যেতে, “গ্যক” (ㄱ) অক্ষরের মতন বেঁকে থাকা বৃদ্ধা মানুষটি তোমাকে নিঃশব্দে ওঁর সঙ্গে আসতে বলতেন – অন্ধকার একটা ঘর, যেটা খাবার ঘর হিসাবে ব্যবহার হত, সেখানে। তুমি জানতেই যে এইবারে তিনি তাঁর ভাঁড়ারের দরজাটি খুলে তোমাকে তেল আর মধু দিয়ে তৈরী পেস্ট্রি আর চালের গুঁড়ি দিয়ে বানানো কেক বের করে দেবেন। এগুলি রাখা থাকত উৎসবে-ব্যসনে অথবা কোনো আত্মিয়ের মৃত্যুতে সকলকে দেবার জন্য। পেস্ট্রিটা হাতে নিয়ে তুমি একটা বেশ ষড়যন্ত্রের মতন হাসি দেবে, তিনিও পালটা হাসবেন, একইভাবে – তাঁর চোখদুটি যেন আরও বেশী কোটরে ঢুকে যাবে। মানুষটা নিজে সারাজীবন যেমন চুপচাপ, শান্তশিষ্ট, নজরের বাইরে থেকে গেলেন, তাঁর মৃত্যুটাও ঠিক সেরকমই হল যেন। ওঁর মুখের ওপর দিয়ে ফরফরিয়ে কিছু চলে গেল যেন – যেন অক্সিজেন মাস্কটা ভেদ করে একটা পাখি ওঁর নিমিলীত চোখদুটি থেকে বেরিয়ে কোথায় উড়ে গেল। তাঁর সেই ঈষৎ হাঁ করে থাকা মুখটির দিকে তুমি চেয়ে রইলে – সে মুখ হঠাৎই হয়ে গেছিল একটা শবদেহের মুখ – আর চেয়ে চেয়ে ভাবছিলে ঐ ফরফর করা জিনিষটা কোথায় মিলিয়ে গেল!

এখন যাঁরা এই জিমখানার হলে শুয়ে আছেন – তাঁদের আত্মাও কি এভাবেই তাঁদের শরীর ছেড়ে পাখীর মত ফরফর করে পালিয়ে গেছে? কোথায় যেতে পারে তারা? স্বর্গ বা নরকের মত কোনো অচেনা অজানা জায়গায় নিশ্চই যায়নি – যাদের কথা তুমি আর তোমার বন্ধুরা সেবার ইস্টারের ডিমের লোভে সানডে স্কুলে গিয়ে শুনেছিলে? টিভিতে যে সব পৌরাণিক নাটক দেখায়, যেখানে মৃত আত্মারা সব ভয়ঙ্কর চেহারায় সাদা পোশাক পরে আর আলুথালু চুলে অশান্ত হয়ে কুয়াশার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, সেসবে তোমার কোনোদিনই তেমন বিশ্বাস জাগেনি তো।

হঠাৎ তুমি টের পেলে মাথায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে – তুমি মুখ তুলে তাকাতে সেই ফোঁটাগুলি তোমার গালে, কপালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই যেন ওই একটা দুটো ফোঁটা যেন বড় হয়ে চারদিক ঝাপসা করে প্রবল বেগে এবং মুষলধারে পড়তে শুরু করল। 

মাইক্রোফোন হাতে মানুষটি চিৎকার করছিল – “সবাই বসে থাকুন – স্মৃতিচারণ পর্ব এখনো শেষ হয়নি। যাঁরা চলে গেছেন, এই বৃষ্টি আসলে তাঁদেরই আত্মার অশ্রুধারা।“

ঠান্ডা বৃষ্টির জল তোমার ইউনিফর্মের কলারের কাছ দিয়ে ভিতরে ঢুকে তোমার ভিতরের গেঞ্জিটাকেও ভিজিয়ে তোমার পিঠ দিয়ে গড়াচ্ছিল। আচ্ছা, আত্মাদের চোখের জল তাহলে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডায় তোমার হাতে, পিঠে কাঁটা দিয়ে উঠছিল, তুমি দৌড়ে প্রধান দরজার কাছে যে ছাউনি মতন আছে, তার নীচে গিয়ে দাঁড়ালে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। আঞ্চলিক অফিসের সামনের গাছগুলো বৃষ্টিতে উথাল পাথাল হচ্ছে। দরজার একদম কাছে সবচেয়ে উঁচু সিঁড়ির ধাপটায় পা মুড়ে বসে তুমি তোমার পুরনো বায়োলজি ক্লাসের কথা চিন্তা করছিলে। অস্তগামী সূর্যের আলোয় পঞ্চম পিরিয়ডে সেই গাছেদের শ্বসনতন্ত্র পাঠ যেন কোনো অন্য জগতে ঘটেছিল বলে মনে হচ্ছিল এখন। তুমি পড়েছিলে, গাছেরা নাকি দিনে একবার মাত্র নিশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকে। যখন সূর্য ওঠে, তখন সেই সূর্যালোকের একটা লম্বা, আরামদায়ক চুমুক দিয়ে তাদের দিন শুরু হয় আর দিনের শেষে যখন সূর্য অস্ত যায়, একটা বিরাট কার্বন-ডাই-অক্সাইডের প্রশ্বাস ছাড়ে। সারাদিন ধরে সেই দীর্ঘ নিশ্বাস শান্ত স্থৈর্যে ধরে রাখা সেই গাছগুলি এখন বৃষ্টির জলের ঝাপটায় ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছিল। 

সেই অন্য দুনিয়াটা যদি এখনো চালু থাকত তাহলে গত সপ্তাহে তুমি ষান্মাষিক পরীক্ষায় বসতে। আজ যেহেতু রবিবার এবং ঝালিয়ে নেবার জন্য সামনে আর কোনো পরীক্ষার চোখরাঙানি থাকত না, তুমি হয়তো অনেক বেলা অবধি ঘুম দিতে, তারপরে উঠে জিয়ংডে’র সাথে উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলতে। গত সপ্তাহটার মতই সেই অন্য দুনিয়ার সেইসব সময়গুলোও যেন আর বাস্তব বলে মনেই হচ্ছিল না এখন।

গত রবিবার তুমি যখন স্কুলের সামনের দোকানটা থেকে কিছু প্র্যাকটিস করার কাগজ কিনতে গেলে, তখনই ঘটনাটা ঘটেছিল। সশস্ত্র সৈন্যদের হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হতে দেখে ভয় পেয়ে তুমি পাশের নদীর ধারে যাবার একটা ছোট্ট গলিতে ঢুকে পড়েছিলে। উল্টোদিক থেকে একজোড়া নারী-পুরুষ আসছিল – লোকটি একটা স্যুট পরা, হাতে একটা বাইবেল আর স্তবের বই, মহিলাটি গাঢ় নীল পোশাক পরেছিল। যেভাবে ওরা কথা বলছিল, তোমার মনে হয়েছিল ওরা সম্ভবতঃ সদ্যবিবাহিত দম্পতি। রাস্তার একদম ও মাথা থেকে বেশ কয়েকবার সরু গলার চিৎকার ভেসে এল – তারপরেই তিনজন সেনা, হাতে বন্দুক এবং মোটা লাঠি নিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে দৌড়ে নেমে এসে ওই তরুন দম্পতিকে ঘিরে ধরল। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল ওরা যেন কাউকে তাড়া করছিল, ভুল করে এই গলিতে ঢুকে পড়েছে।

“কী হয়েছে? আমরা একটু চার্চে যাচ্ছি ---”

স্যুট পরা মানুষটির কথা শেষ হবার আগেই তুমি দেখতে পেলে একটা লোকের হাত – কী?! তুমি যা দেখছিলে, তা কখনো ঘটা সম্ভব তুমি ভাবতেই পারছিলে না – লোকটার সেই হাত, পিঠ, পা – তোমার মাথা কাজ করছিল না। একটা জলজ্যান্ত মানুষ, “বাঁচাও!” চিৎকার করছিল মানুষটা – তার গলাটা খসখসে হয়ে আসছিল। ওরা লোকটাকে ঐ মুগুরগুলো দিয়ে মেরেই যাচ্ছিল – যতক্ষণ না পাদুটো কাঁপতে কাঁপতে একদম স্থির হয়ে গেল। মেয়েটি পিছন ঘুরে পালানোর বদলে ওখানেই দাঁড়িয়ে আর্তচিৎকার করে যাচ্ছিল – তুমি দেখলে ওরা মেয়েটির চুলের মুঠি ধরল – কিন্তু তারপরে কী ঘটল তোমার আর জানা নেই। তুমি তখন হামাগুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে পাশের রাস্তায় ঢুকে পড়তে ব্যস্ত – আর সেখানে তুমি যা দেখলে, তা তোমার এতক্ষণের অভিজ্ঞতার থেকেও আরও অনেক বেশী অভাবনীয়, অপরিচিত।

***

একটা হাত তোমার ডান কাঁধে ঘষে যাওয়াতে তুমি চমকে গিয়ে মাথা তুলে তাকালে। যেন একটা ক্ষণিকের দৃশ্যের মতই একটা সুগঠিত হাতের ওপর দিয়ে যেন টুকরো টুকরো ঠান্ডা কাপড় জড়িয়ে আছে।

“ডং হো?”

মাথার চুল থেকে জিনসের গোড়া পর্যন্ত আপাদমস্তক ভেজা ইউন-সুকের হাসিমুখটা তোমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখছে।

কাগজের মত ফ্যাকাশে মুখে তুমি কোনোমতে একটা আধো হাসি দিতে পেরেছ।

গাধা কোথাকার, ভুতেদের কি হাত থাকে নাকি?

“আমি আরও আগে চলে আসব ভেবেছিলাম – খুব দুঃখিত, তুমি এই বৃষ্টিটায় আটকে গেলে। আসলে ভয় পাচ্ছিলাম, আমি চলে এলে বাকিরাও সবাই উঠে চলে যেত হয়তো। এখানে কিছু হল নাকি তেমন?”

তুমি মাথা নাড়লে, “না, কেউই কাউকে খুঁজতে আসেনি আর এর মধ্যে, কোনো পথচারীও আসেনি”

“ওখানে স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানেও একই হাল – খুব একটা বেশী কেউ আসেনি”।

ইউন-সুক তোমার পাশে উবু হয়ে বসে ওর হুডির পকেট থেকে একটা স্পঞ্জ কেক বার করল, তারপরে একটা দইএর পাত্রও।

“চার্চের মাসিরা এগুলো বিলি করছিল, আমি ভাবলাম আমিও একটু নিয়ে আসি”।

প্লাস্টিকের প্যাকেটটা ছিঁড়ে স্পঞ্জ কেকে একটা কামড় বসাবার পর তুমি বুঝতে পারলে যে তোমার খুব খিদে পেয়েছিল। দইএর প্যাকেটের ঢাকাটা ছাড়িয়ে ইউন-সুক তোমার দিকে এগিয়ে ধরেছে।

“এখন আমি আছি – তুই বাড়ি যা, জামাকাপড় ছেড়ে নে। কারুর আসার হলে এতক্ষণে এসে চলেও যেত”

“না না, তুমি যাও – আমি সামান্যই ভিজেছি” মুখ ভর্তি স্পঞ্জ কেক নিয়েই কোনোমতে বললে তুমি। কেকটা কোনোমতে গিলে নিয়ে খানিকটা দই গলায় ঢেলে নিলে তুমি।

“এই জায়গাটা ঠিক অঞ্চল অফিসের মত ঘরোয়া না – বুঝলি?” ইউন-সুক নরম সুরে বলে, “তুই বড্ড পরিশ্রম করছিস” –

তোমার মুখ লাল হয়; তুমি জানো তোমার গা থেকে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছে। যখনই লাগোয়া ছোট্ট বাথরুমটায় হাত ধুতে যাও, তোমার চুলগুলোকে একটু জল দিয়ে একটু চট করে ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করো তুমি। ওই পচাগলা দুর্গন্ধটা যেন তোমার চামড়ার মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে – রাতে তাই তুমি তোমার সারা গায়ে ঠান্ডা জল ঢালতে থাকো – তোমার দাঁতে দাঁত লেগে কাঁপুনি লাগে, হাঁচি হতে থাকে, তবুও। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন এসবে তোমার কিছু তেমন আসে যায় না।

“জমায়েতের ওখানে শুনলাম আজ রাতে নাকি সেনারা শহরে ফিরে আসতে পারে। বাড়ি যদি যাস, তাহলে ওখানেই থেকে যাস – আজ রাতে আর এদিকে ফিরে আসার চেষ্টা করিস না।“

ইউন-সুক তার কাঁধ দুটো সোজা করে, চুলগুলো ওর কাঁধের ওপর গড়িয়ে গিয়ে পড়ে। ও ওর ভিজে চুলগুলোর মধ্যে দিয়ে আঙুল চালাচ্ছে, সোয়েটারটা ঝেড়ে নিচ্ছে, তুমি দেখছ। প্রথমদিন যখন দেখেছিলে, ওর গোলগাল মুখটায় বেশ একটা মিষ্টি সৌন্দর্য ছিল, এখন এই কদিনেই সেই মুখটা শক্ত এবং ভোঁতা হয়ে গেছে অনেকটাই। ওর ছায়াচ্ছন্ন, ফাঁকা দৃষ্টির চোখদুটি দেখতে দেখতে তুমি ভাবতে থাকো, একটা মানুষ যতক্ষণ জীবিত থাকে, সেই প্রাণপাখীটা কোথায় থাকে শরীরের মধ্যে? ওই কুঁচকে যাওয়া ভুরুর ভিতর, মাথার পিছনের ওই মুকুটের মত উঁচু হয়ে থাকা অংশটায়, নাকি হৃদপিণ্ডের কোনো অজানা প্রকোষ্ঠে?

কেকের শেষ অংশটুকু মুখে পুরে চিবাতে থাকছ তুমি, এমন ভান করছ যেন ইউন-সুক এখনই সেনাবাহিনী নিয়ে যা বলল সেটা তোমার কানেই যায়নি।

“একটু ঘামে আর কী বা হবে?” তুমি বললে, “কত লোক এই বৃষ্টিতে ভিজে একশা হয়েছে – তাদের যাওয়া দরকার জামাকাপড় ছাড়তে”

ইউন-সুক তার পকেট হাতড়ে আরেকটা দইএর প্যাকেত বার করে।

“এটা সিওন-জুএর জন্য এনেছিলাম – এটা তুইই নে, আস্তে আস্তে খা, কোনো তাড়া নেই, গিলতে হবে না। কেউ তোর মুখ থেকে কেড়ে নিতে যাচ্ছে না।“

তুমি লোভীর মত প্যাকেটটা হাতে নিলে, ডাকনাটা নখ দিয়ে খুলে ফেলে এক গাল হাসলে।

সিওন-জু অবশ্য ইউন-সুকের মত নিঃশব্দে এসে তোমার কাঁধে হাত রাখার বান্দিই নয়। আসতে আসতে বেশ কয়েক মিটার দূর থেকেই পরিস্কার বাজখাঁই গলায় সে তোমার নাম ধরে হাঁক পাড়ে।

“কেউ আসেনি?” আরেকটু কাছাকাছি হতেই, যখন আর চেঁচাতে হবে না বলে সে নিশ্চিত হয়, সে জানতে চায়। “তুই এখানে একা একাই ছিলি সারাক্ষণ?” তোমার আগের ধাপের সিঁড়িতে থেবড়ে বসে পড়ে ও তোমার দিকে ফয়েলে মোড়ানো একটা গিম্বাপের ঠোঙা বাড়িয়ে ধরে। তুমি দুই আঙুলের ফাঁকে এক চিমটে তুলে নিয়ে মুখে চালান করলে – সিওন-জু তখন ক্রমশঃ ধরে আসা বৃষ্টিটার দিকে তাকিয়েছিল একদৃষ্টে।

“তোর বন্ধুকে তাহলে খুঁজে পেলিনা এখনও?” প্রশ্নটা এমনই আচমকা চিটকে এল যে তোমার মাথা নাড়তেও কয়েক মুহুর্ত দেরি হল। “হতে পারে”, সিওন-জু তড়বড়িয়ে বলে গেল, “এখনো পাসনি যখন, হয়তো সেদিনই সেনারাই ওকে কবর দিয়ে দিয়েছে কোথাও”। তুমি হাতটা বুকের ওপর ঘষছিলে – সী-উইড মোড়ানো ভাতের শুকনো দলাটা হঠাৎই তুমি যেন তোমার গলায় আটকে গেছে। “আমি সেদিন ওখানে ছিলাম, জানিস। সৈন্যগুলো ওদের হাতের কাছে গুলি খেয়ে যে লাশগুলো পড়েছিল সেগুলো একটা ট্রাকে তুলে নিল”। তুমি অপেক্ষা করছিলে, আরও কথার তোড়ের জন্য – কিন্তু আর কিছু মনে হয় ওর বলার নেই।

“তুমি ভিজে গেছ তো পুরো”, তুমি বললে, “ঘরে যাও, জামা-কাপড় ছাড়ো। ইউন-সুক আগেই চলে গেছে”

“কী করতে? সন্ধেবেলা আবার কাজ শুরু হলেই তো বালতি বালতি ঘামব” বৃষ্টির ঝরোখা দেখতে দেখতে সিওন-জু অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলটাকে ভাঁজের পর ভাঁজ করেই যাচ্ছিল – যতক্ষণ না সেটা একটা কড়ে আঙুলের মাপের হয়ে ওর হাতের মুঠোর মধ্যে ঢুকে গেল। পাশ থেকে ওকে দেখে বেশ শান্তশিষ্ট এবং দৃঢ় দেখাচ্ছিল – দেখতে দেখতে একটা প্রশ্ন তোমার মনের মধ্যে গজিয়ে উঠছিল –

যারা আজ থেকে যাবে তারা কী সত্যিই সবাই খুন হয়ে যাবে?

একটু দোনোমোনো করে তুমি প্রশ্নটা করে ফেলাই সমীচিন মনে করলে। যদি সত্যি সত্যিই সেরকমই কিছু হবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তো সকলেরই আঞ্চলিক অফিস ছেড়ে চলে গিয়ে বাড়িতেই লুকিয়ে থাকা উচিত কেউ কেউ চলে যাবে আর কেউ কেউ থেকে যাবে, এটা কেমন করে হয়?

সিওন-জু ওই ছেঁড়া ফয়েলটাকে ফুলগাছের গোড়াউ ছুঁড়ে ফেলে নিজের খালি হাতটার দিকে দেখল, তারপর ওর ক্লান্ত চোখদুটোকে জোরে জোরে ঘষতে লাগল, তারপর গালে, কপালে এমনকি কানেও ঘষতে লাগল।

“আমি আর চোখ খুলে রাখতে পারছি না। ভাবছি এই লাগোয়া ঘরটায় গিয়ে একটা একটা সোফা বা যে কোনো সুবিধেমত জায়গা দেখে ঝট করে এক ঘুম দিয়ে নিই। সেই ফাঁকে আমার জামাকাপড়গুলোও শুকিয়ে নিতে পারব।“ সিওন-জু ওর সুসজ্জিত সামনের দাঁতগুলো বের করে হাসল, “ও বেচারা ডং হো – আবার তোকে একা ফেলে চলে যাচ্ছি রে”

হয়তো সিওন-জু ঠিকই বলছে, হতেই পারে যে সৈন্যরাই জিওং-ডে কে তুলে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও কবর দিয়ে দিয়েছে। আবার অন্যদিকে তোমার মা’য়ের দৃঢ় বিশ্বাস যে ও কোনো না কোনো হাসপাতালে ভর্তী হয়ে চিকিৎসা পাচ্ছে – এখনো ওর হয়তো জ্ঞান ফেরেনি, তাই যোগাযোগ করতে পারছে না। মা তোমার মেজোভাইকে নিয়ে গতকাল এসেছিলেন এখানে, তোমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘরে নিয়ে যাবার জন্য। তুমি যখন জোর করে বললে যে জিওং-ডে কে খুঁজে না পেলে তুমি কিছুতেই বাড়ি যাবে না, তিনি বলছিলেন, “আমাদের আই সি ইউ গুলোতে খোঁজ নেওয়া দরকার। চল আমরা একসাথেই যাই।“

এই বলে তিনি তোমার ইউনিফর্মটা চেপে ধরেছিলেন।

“লোকের কাছে যখন শুনলাম তুই এখানে, কতটা চমকে গেছিলাম জানিস? হায় ভগবান, এতগুলো লাশ! তোর এখানে ভয় করে না?”

“সৈন্যদের দেখলে ভয় লাগে” মুখে একটা অস্ফুট হাসি টেনে বললে তুমি, “মৃতদেহতে ভয়ের কী আছে?”

তোমার মেজোভাইএর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তোমার সোজা সরল ভাই – যে তার বাল্যকালের বেশীটা সময়েই এমনভাবে পড়াশুনা করে গেছেযেন দুনিয়ায় আর কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই – কিন্তু তারপরে এখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পরীক্ষায় বসে ভুলের অর ভুল করে যাচ্ছে। আপাতত সে তৃতীয়বারের মত চেষ্টায় আছে। ঘন দাড়ি আর তোমার বাবার মত চওড়া মুখ নিয়ে ওকে ওর বয়সের তুলনায় অনেকটাই বড় দেখায়, উনিশ বলে মনেই হয় না। তোমার বড় ভাই এর ঠিক উলটো – সে সিওলে নবম ধাপের সিভিল সার্ভেন্ট হিসাবে কাজ করে – তার চেহারার কমনীয়তা দেখলে তোমার অনেক সময় তাকে “সুন্দর” বলতেই ইচ্ছে করে। ও যখন ছুটিছাটায় গুয়াংজুতে আসে, তোমরা তিনভাই একসাথে থাকলে সবাই তোমার মেজোভাইকেই সবচেয়ে বড় বলে ভুল করে।

বিশেষ যুদ্ধ কম্যান্ডের প্যারাট্রুপারেরা ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে – তুই কী সত্যিই ভাবছিস ওরা কয়েকটা সিভিলিয়ান, যারা সেই যুদ্ধের পর থেকে ব্যবহার না হওয়া কয়েকটা রাইফেল বাগিয়ে বসে আছে, তাদের ভয়ে কাঁপছে? ভাবছিস সেইজন্যই ওরা এখনো শহরে আবার ঢোকেনি? ওরা শুধু সময় আসার অপেক্ষা করছে, যখন ওদের ওপর মহল থেকে আদেশ আসবে। এখানে যদি থেকে যাস, ওরা যখন ফিরে আসবে, তোকেও মেরে ফেলবে।“

তুমি এক পা পিছিয়ে গেলে, ও তোমার কানের গোয়ায় একটা চাটি মেরে বসতে পারে এই ভয়ে।

“ওরা আমাকে মারতে যাবে কেন?”তুমি বললে, “আমি শুধুই এটা ওটা কাজে একটু সাহায্য করছি, হাত লাগাচ্ছি” তুমি হাতটা একটু ঝাঁকিয়ে তোমার মায়ের চেপে ধরা হাতগুলো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলে। “ভেবো না, ওদের সাহায্য করার কাজটা শেষ হয়ে গেলেই আমি বাড়ি ফিরে আসব, জিয়ং ডে কে খুঁজে নিয়ে” – তুমি এক দৌড়ে জিমন্যাশিয়ামের ভিতর চলে গেলে, কাঁধের ওপর দিয়ে কোনোমতে হাত নাড়তে নাড়তে।

আকাশটা অনেক্ষণ ধরেই আস্তে আস্তে পরিস্কার হচ্ছিল – এখন হঠাৎ যেন ঝলমল করে উঠল। তুমি উঠে দাঁড়ালে, তারপর বিল্ডিংটার ডানদিক বরাবর হাঁটতে শুরু করলে। লোকজন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার ফলে চত্বরটা এখন পুরোই ফাঁকা। শুধু কিছু শোকগ্রস্ত পরিবারের বিবর্ণ লোকজন ফোয়ারাটার কাছাকাছি দুজন তিনজন করে বসে আছেন। শোকগ্রস্ত সেই মানুষগুলি আর মুষ্টিমেয় কয়েকজন, যাঁরা একটা বেদীর নীচে থেকে কফিনগুলি একটা ট্রাকে তুলছেন। উবু হয়ে বসে ঝুঁকে অড়ে তুমি মুখগুলো চেনার চেষ্টা করছিলে, কড়া রোদের রশ্মি এসে পড়ায় তোমার চোখের আতা কাঁপছিল। তোমার গালের পেশীগুলোও তিরতির করে কাঁপছিল ওপর থেকে নীচের দিকে।

প্রথম দিন ইউন-সুক আর সিওন-জু কে যা যা তুমি বলেছিলে, তার মধ্যে সত্যির ছিটেফোঁটাও ছিল না।

তোমার চোখের সামনের এই চত্বরটাতেই সেদিন দলে দলে লোক এসেছিল সভায়, ফেডোরা টুপিধারী বৃদ্ধেরা, বারো বছরের ছেলেমেয়েরা, নানারঙের রঙীন ছোট ছোত ছাতা মাথায় মেয়েরা, সেদিন যখন ওরা একটা হাতে টানা গাড়িতে ট্রেন স্টেশনের সামনে গুলি খাওয়া দুটি লোকের দেহ তুলে নিয়ে একদম সারির মাথায় নিয়ে এসেছিল, সেদিন কোনো পড়শী নয়, জিয়ং ডে কে শেষ ঝলকটা তুমি নিজেই দেখেছিলে। এমনও নয় যে তুমি অনেকটা দূর থেকে কিছু দেখেছিলে, বরং তুই এতিটাই কাছে ছিলে যে পাশ থেকে বুলেট ঢুকে যাবার গর্তটা তুমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলে। শুরুতে তোমরা হাত ধরাধরি করেই হাঁটছিলে, সামনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলে। তারপর কানফাটানো গুলির আওয়াজ বিকেলটাকে চুরমার করে দিল, সকলে ঠেলাঠেলি করে কোনোরকমে যেদিক থেকে এসেছিল সেই রাস্তার দিকে যাবার চেষ্টা করছিল। কেউ একজন চিৎকার করল, “ভয়ের কিছু নেই – ফাঁকা আওয়াজ করছে” বলে। একদল আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল, আর এই ঠেলাঠেলির মধ্যে জিওং ডে’র হাত তোমার হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে গেল। আবার একটা কামানের গোলার মতন আওয়াজ হল আর জিওং ডে একপাশ উলটে পড়ে গেল। তুমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে প্রাণপণে দৌড়ালে। একটা ইলেক্ট্রিকাল সরঞ্জামের দোকানের দেওয়ালের গায়ে সেঁটে দাঁড়িয়য়েছিলে তুমি, নামানো শাটারটার ঠিক পাশেই। তোমার সাথে সেখানে আরও তিনজন বয়স্ক মানুষ ছিল। আরেকজন লোক, যে ওদের দলেরই একজন সম্ভবতঃ, দৌড়ে ওদের দিকেই আসছিল, তখনই হঠাৎ ওর কাঁধ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল আর লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

“হায় ভগবান, ওরা ছাদের ওপর” তোমার পাশের লোকটি বিড়বিড় করছিল, “ওরা ছাদের ওপর থেকে ইয়োন গাই কে গুলি করল।“

সামনের বাড়িটার ছাদ থেকে আরও এক ঝাঁক গুলি ছুটে এল। ইয়োন গাই নামের লোকটি কোনোমতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, পিছনদিকে উলটে গেল, যেন কেউ একজন ওকে ঠেলে ফেলে দিল। ওর পেট থেকে রক্ত বেরিয়ে বুকের অপরটাও ভাসিয়ে দিল। তুমি তোমার পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলোর দিকে তাকালে। কেউ কোনো কথা বলছিল না। আগে যে লোকটি বিড়বিড় করছিল, সে তখন নিঃশব্দে কাঁপছিল থরথর করে, মুখের ওপর হাতটা চাপা দিয়ে।

তুমি এক পলকের জন্য চোখটা খুলতেই দেখতে পেলে সামনের রাস্তার মাঝখানে কয়েক ডজন মানুষ পড়ে আছে। তোমার মনে হল যেন ঠিক তোমার নিজের পরণের মতই নীল ট্র্যাকস্যুটের নীচের অংশ তুমি দেখতে পেলে এক ঝলকের জন্য। পাদুটো খালি – ওর ট্রেনারগুলো কোথায় গেল? তোমার শরীর কাঁপছিল, টানটান হয়ে ছিল – তুমি চিটকে বেরোতে যাচ্ছিলে, কিন্তু তখনই তোমার পাশের লোকটি তোমার কাঁধ খামচে ধরল। ঠিক তখনই পাশের গলি থেকে তিনটি অল্পবয়সী ছেলে দৌড়ে বেরিয়ে এল। ওরা যখন মৃতদেহগুলির বগলের নীচ দিয়ে হাত গলিয়ে ওদের টেনে তুলছিল, আবার চত্বরের মাঝখানেএকদল সৈন্যের দিক থেকে একঝাঁক গুলি ছুটে এল আবার। ছেলেগুলো সুতো কেটে যাওয়া কাঠের পুতুলের মত এদিক ওদিক গড়িয়ে পড়ে গেল। রাস্তার উল্টোদিকের লাগোয়া গলিটার দিকে তাকিয়ে তুমি দেখলে সেখানে প্রায় জনা তিরিশেক নারী-পুরুষ দেওয়ালে ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে স্থির নিস্পলক দৃষ্টিতে সামনের এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে।

গোলাগুলি থেমে যাবার প্রায় মিনিট তিনেক পর অবিশ্বাস্য ছোটখাটো চেহারার একজন লোক ওইদিক থেকে দ্বিধাহীনভাবে দৌড়ে বেরিয়ে এল। যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে সে মাটিতে পড়ে থাকা একজনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আরেক ঝাঁক গুলি এসে তাকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দেবার সময়ে যে লোকটি আমার কাঁধ খামচে ধরেছিল, সে তার কর্কশ চওড়া হাতটা আমার চোখের ওপর চাপা দিয়ে বলল, “এখন ওদিকে যাবার চেষ্টা করলে তুমি শুধুই প্রাণটা বেঘোরে দেবে”।

যে মুহুর্তে লোকটি তোমার চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল, তুমি দেখলে উল্টোদিকে গলি থেকে আরও দুটো লোক একটি নারীর দিকে যেন কোনো প্রকাণ্ড চুম্বকের আকর্ষণে ছুটে গেল, মেয়েটির দুটি হাত দুদিক থেকে ধরে তাকে তুলল। এবারের গুলিটা এল ছাদের ওপর থেকে। লোকদুটো ডিগবাজি খেয়ে হেটমুণ্ড উর্দ্ধপদ হয়ে পড়ে গেল।

এরপরে আর কেউ কাউকে উদ্ধার করার কোনো চেষ্টা করেনি।

আরও প্রায় দশ মিনিট নিঃশব্দে কাটল, তারপর সেনাদের সারি ভেঙে দু ডজন সৈন্য এগিয়ে এসে জোড়ায় জোড়ায় তাদের কাছাকাছি পড়ে থাকা লাশগুলির দিকে এগিয়ে গেল। ওরা দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে দেহগুলিকে টেনে টেনে অন্য সৈন্যরা যেখানে আছে সেখানে নিয়ে গিয়ে জড়ো করছিল। যেন এই ইঙ্গিতটারই অপেক্ষা ছিল, আমাদের পাশের এবং উল্টোদিকের গলি থেকে প্রায় এক ডজন মানুষ দৌড়ে বেরিয়ে এল, যে শরীরগুলো পিছনের দিকে পড়ে আছে সেগুলোকে তুলে আনার জন্য। এবারে আর কোনো গুলির শব্দ শোনা গেল না। তোমার পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল, সে এবার দেওয়ালের নিরাপত্তা ছেড়ে একদল মৃতের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর দ্রুত গলিপথে মিলিয়ে গেল। কিন্তু এতকিছুর পরেও তুমি জিওংডে কে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে না। এখানে একা হয়ে যাবার পর তুমি ভীত হয়ে পড়েছিলে আর শুধু স্নাইপারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কথা ভেবে চলেছিলে, ভাবতে ভাবতেই তুমি দেওয়াল ঘেঁষে পাশের দিকে সরতে সরতে দেওয়ালের ইঁটে প্রায় মুখটা ঠেসে ধরেছিলে, চত্বরটাকে পেছনে রেখে।