
দুধসায়রের দ্বীপ - শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের তেইশতম আখ্যান
- 07 May, 2025
- লেখক: মনীষা নস্কর
২৩ নম্বর অদ্ভুতুড়ে— দুধসায়রের দ্বীপ
এর আগের দুই অদ্ভুতুড়ে যদি ডাইনিং টেবলের মেইন কোর্স হয়ে থাকে, শীর্ষেন্দুর এই তেইশ নম্বর অদ্ভুতুড়েকে নির্দ্বিধায় ‘ডেসার্ট আইটেম’ বলা যেতে পারে। ছোট্ট মিষ্টি একটা গল্প, তবে আয়তনে ছোট হলেও খেয়ে, থুড়ি পড়ে দিব্যি তৃপ্তি মেলে।
‘দুধসায়রের দ্বীপ’-এর স্টোরিলাইনে বিশাল কিছু অভিনবত্ব নেই। রাজবাড়ি, গুপ্তধন, দুষ্টু লোকের হামলা— এ মোটামুটি চেনা ছক হয়ে গেছে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের।
ছোট্ট ছেলে পুটু এসেছে বিদ্যাধরপুর গ্রামে বেড়াতে। দাদু গগনবাবু মিলিটারির চাকরি থেকে রিটায়ার করে গ্রামেই থাকেন এখন। পুটুকে এটা সেটা গল্প শোনাচ্ছে খাসনবিশ, টুক করে সেই ফাঁকে গল্পের ইন্ট্রোও দিয়ে দিলেন লেখক। গ্রামে আছে কোনও এক রাজা প্রতাপচন্দ্রের রাজবাড়ি। রাজা প্রতাপচন্দ্র আক্ষরিক অর্থেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ যাপন করেছিলেন।
“রাজা প্রতাপচন্দ্র জীবনে ছোটখাটো কাজ করেননি কখনও, ছোট কাজ করতে ভারী ঘেন্না করতেন। তাঁর কথা ছিল, মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। কুমড়োর সাইজের রসগোল্লা খেতেন, লাউয়ের সাইজের পান্তুয়া।
তাঁর তরোয়ালখানার ওজন ছিল প্রায় আধ মন।"
"এঃ, অত বড় তলোয়ার নিয়ে কেউ যুদ্ধ করতে পারে?"
"যুদ্ধ! যুদ্ধ করার দরকারটা কী? প্রতাপচন্দ্র নিজেও তলোয়ারটা তুলতে পারতেন না। কথাটা হল, উনি সবসময়ে বড়-বড় কাজ করতে ভালবাসতেন। শুনেছি একবার ঘুড়ি ওড়ানোর শখ হওয়াতে কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুট একখানা ঘুড়ি তৈরি করিয়েছিলেন আর পিপের সাইজের লাটাই।"
"ও বাবা! সে-ঘুড়ি ওড়াল কে?"
"কেউ না। ঘুড়ি মোটে আকাশে ওড়েইনি। কিন্তু তাতেও রাজা প্রতাপের নামডাক খুব বেড়ে গিয়েছিল। এই যে সমুদ্দুরের মতো জলাশয় দেখছ এও রাজা প্রতাপের এক কীর্তি।"
গল্পে রহস্য দানা বেঁধে ওঠে এই মস্ত পুকুরের মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপকে ঘিরেই। রাজার তো সব তাতেই বাড়াবাড়ি ছিল। সায়র নামের উপযুক্ত বড়সড় একখানা পুকুর খুঁড়লেন বটে কিন্তু জল তাতে উঠল না। স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনহাজার গয়লাকে দিয়ে ঘড়া ঘড়া দুধ ঢালালেন। গয়লারা নির্ঘাত দুধে জল মিশিয়েছিল, তাই শেষমেশ সায়র উপচে জল উঠে পড়ল। নাম হল তার দুধসায়র। দুধসায়রের মাঝে ভেসে রয়েছে বাতাসার মতো ছোট্ট দ্বীপ, সেখানে ছিল প্রতাপচন্দ্রের বাগানবাড়ি।
ইদানীং নাকি বাতাসা দ্বীপে ভূতের উৎপাত শুরু হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ সাতফুট লম্বা একটা লোককে দেখা যায়। গ্রামের মানুষজন ভূতপেত্নী ব্রহ্মদত্যিদের বিশ্বাস করতে বড্ড ভালোবাসে। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ বলতে তো ওটুকুই। কাজেই সাতফুট লম্বা লোক দেখে ভূত বলে ভেবে নিতে তাদের একটুও কষ্ট হয় না। খতিয়ে দেখতেও চায় না সাতফুট ভূত জনমানবশূন্য দ্বীপের ভাঙা বাগানবাড়িতে একলাটি কী করছে।
তবে গ্রামের সবাই তো আর বুদ্ধিসুদ্ধি বন্ধক রেখে বসে নেই। কেউ কেউ আছে, তাদের মাথাটা বেশ সাফসুতরো। কমনসেন্সটা তাদের কাছে অতটা আনকমন নয়, এমন কয়েকজন হল গ্রামের রসময় পুরোহিত, মিলিটারি দাদু গগনবাবু।
গল্পের আর এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র জগাপাগলা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের এইসব পাগলদের নিয়েই আস্ত একখানা প্রবন্ধ লিখে ফেলা যায়। জগাপাগলা আর রসময় পুরোহিতের কথা চলছে।
“আজ কী নিয়ে ভাবনায় পড়লে হে জগা? বড্ড তন্ময় দেখছি যে!"
জগা সোজা হয়ে বসে গোঁফদাড়ির ফাঁক দিয়ে একটু হাসল। তারপর বলল, "আজ্ঞে, বড্ড সমস্যায় পড়ে গেছি।"
"কী নিয়ে সমস্যা?"
"আজ্ঞে, খিচুড়ি নিয়ে।"
"খিচুড়ি? সে তো ভাল জিনিস। সমস্যাটা কোথায়?"
"সমস্যা আছে। ধরুন চালেডালে মিশিয়ে সেদ্ধ করলে তো খিচুড়ি হয়, না কি?"
"তা বটে।"
"কিন্তু ডালভাত মাখলে তো তা হচ্ছে না।"
"না, তা হচ্ছে না।"
"ওইখানেই তো সমস্যা। চালেডালে সেদ্ধ করলে খিচুড়ি, আর চাল আলাদা ডাল আলাদা সেদ্ধ করলে ডালভাত, এটা কেন হচ্ছে বলুন তো ঠাকুরমশাই?"
"ও বাবা, এ তো জটিল প্রশ্ন দেখছি।"
"খুবই জটিল। যত ভাবছি তত জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কেউই কোনও সমাধান দিতে পারছে না। আপনি তো মেলাই শাস্ত্রটাস্ত্র জানেন, আপনি বলতে পারেন না?"
"না বাপু, শাস্ত্রে খিচুড়ির কথা পাইনি।"
"সেইটেই তো মুশকিল, সায়েন্সে খিচুড়ির কথা আছে মনে করে গোবিন্দর কাছে গিয়েছিলুম। তা সে বলল, খিচুড়িও আসলে ডালভাতই। শুনে এমন রাগ হল! এই বিদ্যে নিয়ে গোবিন্দ নাকি আবার কলেজে সায়েন্স পড়ায়। ছ্যাঃ ছ্যাঃ।"
"তা বাপু, খিচুড়ির কথাই শুধু ভাবলে চলবে কেন? ধরো দুধে চালে সেদ্ধ করলে পায়েস, আবার দুধেভাতে মাখলে দুধভাত। এটাই-বা কেমন করে হচ্ছে?"
ভারী বিরক্ত হয়ে জগা বলল, "আহা, খিচুড়ির কথাটাই আগে শেষ হোক, তবে না পায়েসের কথা! আলটপকা খিচুড়ির মধ্যে পায়েস এনে ফেললে একটা ভজঘট্ট লেগে যাবে না?"
পাগলের প্রলাপের মাঝেই রসময় খবর পেয়ে যান, জগাপাগলাকে ‘বামাচরণ’ নামের একজন অচেনা মানুষ একটি অস্ত্র দিয়েছে বাঘ মারার জন্য। বদলে গাঁয়ের রাজবাড়ির লোহার শূলটা তাকে সরিয়ে এনে লোকটাকে দিতে হবে। অস্ত্রও যে সে অস্ত্র নয়, সেটি একটি পিস্তল।
থানায় এত্তেলা গেল। থানার দারোগা মদন হাজরা বারোমাস আমাশায় ভোগেন। জগাপাগলার বয়ানমতো তিনি আশেপাশের পাঁচ-ছটা গ্রাম থেকে এগারোজন বামাচরণকে কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে গ্রেফতার করে আনলেন। জগা এল তার বামাচরণটিকে শনাক্ত করতে।
“সে উঠে প্রথম লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, লোকটা ছ' ফুট লম্বা, তেমনই চওড়া, বিরাট পাকানো গোঁফ, চোখদুটো বাঘের মতো গুল্লুগুল্লু।
জগা একগাল হেসে বলল, "আজ্ঞে, ইনিই সেই বামাচরণ। একেবারে হুবহু তিনিই-"
লোকটা চোখ পাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বলল, "অ্যাঁ!"
জগা দু'হাত পেছিয়ে গিয়ে বলল, "আজ্ঞে না। আপনি না। বামাচরণবাবুর বোধ হয় গোঁফ ছিল না।"
দ্বিতীয়জন বেঁটেখাটো, মাথায় টাক, দাড়িগোঁফ কামানো। জগা তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলে উঠল, "আরে! এই তো বামাচরণবাবু! এই তো সেই-"
লোকটা দাঁতে দাঁত পিষে বলল, "ইয়ার্কি হচ্ছে! ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাওনি, হনুমান কোথাকার!"
জগা চোখ মিটমিট করতে-করতে বলল, "আজ্ঞে ইনি হবেন কী করে? বামাচরণবাবুর যে বাঁ গালে আঁচিল ছিল!"
তৃতীয়জন পাকা দাড়িওলা বুড়ো মানুষ। চশমার ফাঁক দিয়ে জগাকে দেখছিলেন। হাতে লাঠি।
জগা গদগদ হয়ে বলল, "পেন্নাম হই বামাচরণবাবু, কতদিন পরে দেখা! সেই যে হাটে বাঘ মারার অস্তরটা দিলেন, তারপর আর দেখাই নেই! ভাল আছেন তো! বাড়ির খোকাখুকিরা সব ভাল?"
একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বুড়ো বামাচরণ বললেন, "হাতের লাঠিটা দেখছ তো! এমন দেব কয়েক ঘা-"
জগা সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, "আরে না, আপনার কথা হচ্ছে না, আপনার কথা হচ্ছে না। সেই বামাচরণের তো দাড়িই ছিল না মোটে।"
চতুর্থজন বয়সে ছোকরা, ভাল করে দাড়িগোঁফ ওঠেনি। জগা মিটমিট করে তার দিকে চেয়ে থেকে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, "বামা না! উঃ, কী সাঙ্ঘাতিক জিনিসই দিয়েছিলি বাপ! কী শব্দ,, কী তেজ অস্তরটার!"
ছোকরা ফ্যাচ করে হেসে বলল, "জগাপাগলা, এক মাঘে শীত যায় না, বুঝলে। আমার জগদ্ধাত্রী ক্লাবের ছেলেরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ঢিল মেরে তোমার মাথার চাঁদি উড়িয়ে দেবে আজ-"
জগা গম্ভীর হয়ে বলল, "আমি কি তোকে কিছু বলেছি রে বামা? বল তো, বলেছি? ওরে, আমার সেই বামাচরণের যে পেল্লায় দাড়িগোঁফ ছিল, তুই তো দুধের শিশু।"
পঞ্চমজন বেশ লম্বা একহারা চেহারার মানুষ। মুখখানা ভারী বিনয়ী। জগা তার দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা চাপা গলায় বলে উঠল, "জিলিপি খাবে বলে জষ্টিমাসে যে আড়াইটে টাকা ধার নিয়েছিলে সেটা এবার ছাড়ো তো বাপু। নইলে দারোগাবাবুকেই কথাটা বলতে হয়।"
জগা সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, "এ নয়। এ একেবারেই বামাচরণ নয়। কিছুতেই নয়। এ হতেই পারে না!"
ষষ্ঠজন এক আখাম্বা তান্ত্রিক। কাঁচাপাকা দাড়ি, রক্তাম্বর, কপালে প্রকাণ্ড তেল-সিঁদুরের তিলক, চোখ দু'খানা লাল, চেহারাখানাও পেল্লায়।
জগা হাসি-হাসি মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, "বামাবাবু যে! ক'দিনেই চেহারাখানা শুকিয়ে একেবারে আদ্দেক হয়ে গেছে দেখছি? তা বামাবাবাজি-"
তান্ত্রিক বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠল, "জয় শিবশন্তো! জয় মা তারা! তোর মাথায় বজ্রাঘাত হবে রে জগা, এই দিলুম তোকে অভিশাপ-"
তান্ত্রিক অভিশাপ দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই জগা চট করে বসে পড়ল। তারপর একলাফে সরে চারদিকে চেয়ে অভিশাপটা কোথায় পড়ল তা খুঁজে দেখতে-দেখতে বলল, "তা বাজটা কোথায় পড়ল বাবাজি?"
"পড়েনি। পড়বে। তোর নিস্তার নেই রে জগা-"
জগা খুব অভিমানের গলায় বলল, "দিয়েই ফেললেন নাকি শাপটা?"
"এখনও দিইনি। এই দিচ্ছি-"
"থাক, থাক। আপনি মোটেই সেই বামাচরণ নন। সেই বামা পিস্তল নিয়ে ঘোরে, বাজ নিয়ে নয়।"
সপ্তমজন রোগাপাতলা চালাক-চালাক চেহারার একজন লোক। বাহারি সরু গোঁফ, বাবরি চুল, ঠোঁটে পানের দাগ।
বামাচরণ তার কাছাকাছি যেতেই লোকটা খুব মিহি গলায় বলল, "পরশু হাটুগঞ্জে আমাদের ফুল্লরা অপেরার কৃষ্ণার্জুন পালা হচ্ছে। গিয়ে আমার নাম বোলো গেটম্যানকে, বামাচরণ বিশ্বাস, একেবারে সামনের সারিতে বসিয়ে দেবে।"
জগা একগাল হেসে বলে, "কস্মিনকালে দেখিনি মশাই আপনাকে।"
এগারোজনের মধ্যেও মনের মতো বামাচরণ না পেয়ে জগা পাকড়াও করল খোদ থানার সেপাই গুলবাগ সিংকে! থানার দারোগার চক্ষু চড়কগাছ।
“মদন হাজরার মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, গোঁফ ঝুলে পড়েছে, চেঁচামেচি শুনে দু'হাতে কান চাপা দিয়ে মদন হেঁকে বললেন, "সসম্মানে খালাস! সসম্মানে খালাস! ওরে কে আছিস, বামাচরণদের কোমরের দড়ি খুলে দে..."
এক নম্বর বামাচরণ এগিয়ে এসে মদনের টেবিলে এক পেল্লায় চাপড় মেরে বলল, "শুধু ছেড়ে দিলেই হবে? আমার যে অপমান হল তার জন্য এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ চাই।"
অন্য বামাচরণরাও এককাট্টা হয়ে চেঁচাতে লাগল, "আমি দেড় লাখ চাই। ... আমার সারাদিনের ব্যবসা নষ্ট, পাঁচ লাখের নীচে নামতে পারব না। ...আমার দশ লাখ..."
মদন হাজরা লাফিয়ে উঠে চেঁচাতে লাগলেন, "দরওয়াজা, শিগগির বামাচরণদের সসম্মানে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে থানা থেকে বের করে দে।"
এর পরের ঘটনা আরও জটিল। গগনবাবুর বাড়ির বাগানে জটাকে দিয়ে ফেলানো হল আস্ত একখানা মিলিটারি হ্যান্ড গ্রেনেড। ফেলতে বলা হয়েছিল গগনবাবুর ঘরেই, কিন্তু জটাপাগলা তো খুব বেশি করিৎকর্মা! সে কুকুরের ভয়ে বাগানেই বোমাটা রেখে পালিয়ে গিয়েছিল।
গগনবাবুর ঝি ক্ষান্তমণি সে বোমাকে পাকা কালো আনারস ভেবে বঁটিতে কাটতে বসল। খবর পেয়ে গগনবাবু এসে বোমাটা কেড়ে নিয়ে বালতির জলে চুবিয়ে দিলেন। এর পরের দৃশ্যটি ভোলার নয়। পেটরোগা মদন হাজরা বালতিতে ভেজানো বোমা থানায় নিয়ে যেতে এসেছেন। বালতি গুলবাগ সিংকে ধরিয়ে দিয়ে বাকিরা মারল চোঁ চাঁ দৌড়।
“জলে ভেজানো বোমাটা দেখে আতঙ্কিত হয়ে মদন হাজরা বললেন, "এ তো ডেঞ্জারাস জিনিস দেখছি।"
গগনবাবু বললেন, "হ্যাঁ, মিলিটারিতে ব্যবহার হয়। হাইলি সেনসিটিভ।"
"তা এটা নিয়ে করব কী বলুন তো!"
"নিয়মমতো থানায় নিয়ে রাখতে হবে। তদন্ত করতে হবে।"
"ও বাবা! যদি ফেটেফুটে যায়?"
"ফিউজটা নাড়াচাড়া না করলে ফাটবার কথা নয়। বালতিসুদ্ধই নিয়ে যান।"
মদন হাজরা চোখ বুজে ঠাকুর-দেবতাকে খানিকক্ষণ স্মরণ করে বললেন, "ওরে গুলবাগ সিং, নে বাবা, জয় সীতারাম বলে বালতিটা নিয়ে পেছনে-পেছনে আয়, একটু দূরে-দূরেই থাকিস বাপ। সবাই মিলে একসঙ্গে মরে তো লাভ নেই রে!"
গুলবাগ সিং যথেষ্ট সাহসী লোক। ডাকাবুকো বলে থানায় তার বেশ সুনাম আছে। গুলবাগ একটা তাচ্ছিল্যের "হুঁঃ" দিয়ে বালতিটা হাতে নিয়ে বলল, "চলুন।"
মদন হাজরা এবং অন্য সেপাইরা আগে-আগে, পেছনে গুলবাগ। কিন্তু পথে নেমেই গুলবাগ দেখল, মদন হাজরা আর সেপাইরা বড্ড জোরে হাঁটছে, হাঁটার চেয়ে দৌড়ই বলা ভাল। জলভরা বালতি নিয়ে ওদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া হুড়োহুড়ি করলে নড়াচড়ায় বোমাটা ফেটে যেতে পারে। তাই গুলবাগ ঠোঁট-মুখ কুঁচকে আস্তে-আস্তেই হাঁটতে লাগল। ইতিমধ্যে মদন হাজরা আর সেপাইরা এ ওকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করতে-করতে প্রাণপণে দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেল।”
পথের মধ্যে সেই অচেনা বামাচরণের উদয়। গুলবাগ সিংকে গুলতাপ্পি দিয়ে বোমা নিয়ে সে হল উধাও। আবারও মদন হাজরা গুলবাগ সিংয়ের ডেসক্রিপশন মতো ধরে আনলেন সাতজন সবুজ চেক লুঙ্গি পরা, হাতাওলা গেঞ্জি গায়ে আর গালে খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা লোক।
গুলবাগ সিং প্রত্যেকটার মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে রক্তচক্ষুতে চেয়ে দেখল। এমনকী দিনের আলোতেও টর্চ ফোকাস করে খুঁটিয়ে নিরখ-পরখ করে তারও প্রত্যেককেই সেই লোকটা বলে মনে হতে লাগল। হাল ছেড়ে দিয়ে সে বলল, "বড়বাবু, এদের সবক'টাই বদমাশ বলে মনে হচ্ছে। সবক'টাকেই বরং হাজতে পুরে রাখি।"
এ-কথা শুনে সাতটা লোকই মহা শোরগোল তুলে ফেলল।
তার গতকাল এগারোজন বামাচরণের ঘটনা জানে। তারাও বলতে লাগল, "আমরা মানহানির মামলা আনব। ... সরকার বাহাদুরের কাছে বড়বাবুর নামে নালিশ জানাব... আমাদের এরকম নাহক হয়রানির জন্য মোটা টাকা না দিলে ছাড়ব না....ওরে ভাই, এতক্ষণে আমার দেড় মন মাছ পচে নষ্ট হয়ে গেল, কম করেও হাজার টাকা লোকসান.... আর আমার কী হবে, দোকান ফেলে এসেছি, এতক্ষণে সব লুটপাট হয়ে গেছে..."
মদন হাজরা কানে হাতচাপা দিয়ে বললেন, "ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, যেতে না চাইলে লাঠিচার্জ কর..."
গল্পে রহস্য আরও পেকে ওঠে। কে বা কারা কেনই যে রাজবাড়ির শূলের ওপর নজর দিয়েছে, তার হদিশ মেলে না। শূল নিতান্তই সলিড লোহার তৈরি, ও নিয়ে কার কী কাজ থাকতে পারে? জগাপাগলার কাছে দেওয়া হয় স্টেনগান। গগনবাবুর কুকুরকে কাবু করতে দেওয়া হয় বিষাক্ত মাংসের টুকরো।
“এই যে প্লাস্টিকের ব্যাগে একটুকরো মাংস দেখছ, কুকুরটা এলেই মাংসের টুকরোটা বের করে ছুড়ে দিয়ো। খেয়েই কুকুরটা নেতিয়ে পড়বে। তারপর আর ভয়টা কাকে? ভূতটা ছেড়ে দিয়েই চলে আসবে, পারবে না? সোজা কাজ। আর এই নাও কুড়িটা টাকা, কাল ভূপতির দোকানে গরম-গরম লুচি আর হালুয়া খেয়ো।"
জগা খুশি হয়ে টাকাটা ট্যাঁকে গুঁজে বলল, "খুবই সোজা-সোজা কাজ দিচ্ছেন। মাঝে-মাঝে শক্ত কাজও দেবেন।"
"এক আর বেশি কথা কী? তোমার মতো যোগ্য লোক আর আছেটাই বা কে! তা আজ রাতেই একটা শক্ত কাজ করবে নাকি? যদি করো তো আরও কুড়িটা টাকা আগাম দিয়ে যাই।"
"আজ্ঞে, কী যে বলেন! শক্ত কাজ না পারার কী আছে মশাই! সারাদিন আমি কত শক্ত-শক্ত কাজ করে বেড়াই। এই ধরুন, গাছে উঠে পড়লুম, ফের নেমে এলুম। তারপর ধরুন এই এত বড় একটা ঢিল তুলে ওই দূরে ছুড়ে দিলুম। তারপর ধরুন, দুধসায়র থেকে ঘটির পর ঘটি জল তুলে ফের দুধসায়রেই ঢেলে দিলুম।"
"বাঃ, এসব তো অতি কঠিন কাজ।"
গগনবাবুর নাতি এয়ারগান ছুঁড়ে মারলে গগনবাবু স্টেনগানের গুলির হাত থেকে বেঁচে যান। কিন্তু জগাপাগলা পরবর্তী নির্দেশমতো এগিয়ে যায় রাজবাড়ির দিকে। এলোপাথাড়ি গুলি চালালে রাজবাড়ির দুই দারোয়ান মাথায় ঝাড়বাতির গুঁতো খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আর দারোয়ান রমু হরুয়ার রক্তাক্ত শরীর দেখে এই প্রথমবার জগাপাগলার পাগলামি বুদ্ধিটা একটু যেন থমকে দাঁড়ায়।
“জগার হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে বললেন, "যাও, গিয়ে ঘুমোও। কাল সকালে ওই টাকা দিয়ে জিলিপি খেয়ো।"
কিন্তু জগাপাগলার হঠাৎ যেন কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল। টাকাটা হাত ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হঠাৎ জগা চেঁচিয়ে উঠল, "মোটেই ওটা ভূতযন্ত্র নয়! ওটা বন্দুক। আপনি আমাকে দিয়ে খুন করালেন পরেশবাবু?"
পরেশবাবু একগাল হেসে বললেন, "কেন, খুন করে তোমার ভাল লাগছে না? একটা খুন করতে পারলে আমার কত আনন্দ হত জানো?"
জগা হঠাৎ পরেশবাবুকে জাপটে ধরে চেঁচিয়ে উঠল,
"আপনাকে আমি ছাড়ব না। পুলিশে দেব।”
এইবার সামনে আসে সেই সাতফুট লম্বা বাতাসাদ্বীপের ভূত। পেছন থেকে জগাপাগলাকে মেরে অজ্ঞান করে দিয়ে তারা দুজনে শূল নিয়ে বাতাসা দ্বীপে চলে যায়।
ওদিকে গগনবাবু দারোগা মদন হাজরা, সেপাই গুলবাগ আর রসময় পুরোহিতকে নিয়ে হাজির হন বাতাসা দ্বীপে। দেখা যায়, বাতাসা দ্বীপ তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন, বাগানবাড়ির গুপ্তদরজার খবরও তিনি রাখেন। রাজবাড়ির শূল নিয়ে সেই দুজন দুষ্টু লোক তখন বাগানবাড়ির একটা দেওয়ালে ঢোকানোর চেষ্টা করছে।
মিলিটারি ফেরত মানুষজনদের লেখক সুপারম্যানের চেয়ে কম কিছু মনে করেন না। দুষ্টু লোকেরা স্টেনগান চালাচ্ছে। গগনবাবু স্রেফ একটা আধলা ইঁট ছুঁড়ে দুজনকে ঘায়েল করে ফেললেন।
এরপর রহস্যের জট খোলে। প্রতাপচন্দ্র খেয়ালী রাজা ছিলেন। বাতাসা দ্বীপের বাগানবাড়িতে তিনি একটা দেওয়ালের ভেতরে বানান বিশাল বড় একটি গুপ্ত সিন্দুক। তার চাবি ছিল রাজবাড়ির শূলটি। ছেলেবেলায় গুপ্তধন খোঁজার নেশা ছিল গগনবাবুর। তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে বের করে ফেলেছিলেন ওই শূলই হল গুপ্তসিন্দুকের চাবি। তবে তিনি ভারী সৎ মানুষ। গুপ্তধনের দাবিদার রাজার প্রতাপের বংশধর মহেন্দ্র। সেই মহেন্দ্র আমেরিকায় থাকে। গগনবাবু তাকে গুপ্তধনের কথা জানান। কিন্তু মহেন্দ্র গুপ্তধনে একতুও লোভ নেই, সে নিজের চেষ্টায় বিশাল বড়লোক হয়ে গেছে। সে কখনও ফিরবে না গ্রামে। অগত্যা গগনবাবুও আর কখনও গুপ্তসিন্দুকের তালা খোলার কথা ভাবেননি। কিন্তু মিলিটারিতে জয়েন করার পর এই গল্প তিনি করে বসেন রামলাল ক্ষেত্রীকে। ক্ষেত্রীর ভাই পিট্যুইটারি গ্র্যান্ডের অসুখে ভুগে বেশ লম্বাচওড়া দৈত্যাকৃতি হয়েছে। এরা দুজন আসে গ্রামে। তারা চেয়েছিল গগনবাবুকে নিকেশ করে গুপ্তধন হাতিয়ে চলে যাবে। কাজে লাগিয়েছিল জগাপাগলাকে। তবে তীরে এসে তরী ডুবল তাদের।
গল্পের শেষে জগাপাগলা সুস্থ হয়ে যায়। আর গ্রামের লোক কপাল চাপড়ায়— “গাঁয়ে মোটে ওই একটিই পাগল ছিল, সেও যদি ভাল হয়ে যায় তা হলে কী হবে? পাগল ছাড়া গাঁ যে ভারী অলক্ষুনে!”
আগের অদ্ভুতুড়েতে লেখক গোটা গল্প জুড়ে রহস্য তৈরি করতে করতে এগিয়েছেন। এসেছে একের পর এক ক্লু। জট ছাড়াতে ছাড়াতে এগিয়ে গিয়েছেন ক্লাইম্যাক্সের দিকে। এই ২৩ নম্বর অদ্ভুতুড়েও মিনি রহস্য গল্প। তবে এখানে রহস্যের জট খুলেছে ক্লাইম্যাক্সের শেষে। তেমন কোনও ক্লু গল্পে দেননি। তবে তাতে রহস্যের পেকে ওঠায় কোনও খামতি থাকেনি। গল্পের আয়তন নাতিদীর্ঘ, চরিত্রসংখ্যা কম। ছোট আয়তনেও এ গল্প যথেষ্ট উঁচুদরের।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১ - মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২ - গোঁসাইবাগানের ভূত - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৩ - হেতমগড়ের গুপ্তধন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৪- নৃসিংহ রহস্য - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৫ - বক্সার রতন - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৬ - ভূতুড়ে ঘড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৭ - গৌরের কবচ - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৮ - হীরের আংটি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ৯ - পাগলা সাহেবের কবর - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১০ - হারানো কাকাতুয়া - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১১ - ঝিলের ধারে বাড়ি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১২ - পটাশগড়ের জঙ্গলে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৩ - গোলমাল - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৪ - বনি - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৫ - চক্রপুরের চক্করে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৬ - ছায়াময় - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৭ - সোনার মেডেল - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৮ - নবীগঞ্জের দৈত্য - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ১৯ - কুঞ্জপুকুরের কাণ্ড - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২০ - অদ্ভুতুড়ে - আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২১ - পাতালঘর -আলোচনার লিংক
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ ২২ - হরিপুরের হরেক কাণ্ড -আলোচনার লিংক