
রবীন্দ্রনাথের লিপিকা : ব্যক্তিগত পাঠ অভিজ্ঞতা
- 07 May, 2025
- লেখক: শ্রীপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়
ছিপছিপে চেহারার বই। গেরুয়া মলাটের ওপর লাল কালিতে লেখা তিনটি অক্ষর,'লিপিকা', যেন এক অফুরন্ত আলোর উৎস। আমার ভালোবাসার বই। প্রিয় বই ।
ছোটবেলায় যখন গলানো সোনার মত সকাল আমার দরজায় টোকা দিয়ে বলতো, 'ওঠো' হলদে সবুজ ম্যাজিক লণ্ঠনের অলৌকিক আলোর বিচ্ছুরণে যখন নেমে আসত অপরূপ সন্ধ্যা তখন থেকেই সে আমার সঙ্গী ।
ছোটবেলায় এক শীতের সকালে রোদে পিঠ দিয়ে পড়তে বসে, স্কুলের বাংলা পাঠ্য বই পড়তে পড়তে জোরে জোরে উচ্চারণ করে প্রথম পড়েছিলাম, ''কাঞ্চির রাজা কর্ণাট জয় করতে গেলেন " দেখেছিলাম দাম্ভিক রাজার লোহিত বর্ণ চোখ। "গায়ে রক্তবস্ত্র ,গলায় জবার মালা ,কপালে রক্তচন্দনের তিলক। সঙ্গে কেবল মন্ত্রী আর বিদূষক।" এই রক্তের বর্ণবৈভব যেন নিষ্ঠুরতার প্রতীক ।রাজা তথা প্রশাসনিক শক্তি বিশ্বাস করে ক্ষমতায় ,যুদ্ধে আর যুদ্ধজয়ে।। এতসব সেদিন বুঝিনি, কেবল নতুন গল্পে পেয়েছি এক নতুন স্বাদ। রাজার নিষ্ঠুরতার বিপরীতে দেখেছি বিদূষক এর প্রসন্ন উজ্জ্বল সদাহাস্যময় মুখ। না বুঝেই সেদিন স্পর্শ করেছিলাম প্রাণের আনন্দকে। স্বৈরাচারী রাজার দিক থেকে নিজের অজান্তেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম গল্প পড়ে ।স্বেচ্ছানির্বাসিত বিদূষক এর পেছনে পেছনে দিগন্তের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল মন ।
সেই প্রথম ভালোলাগা এসেছিল পাঠ্য বইয়ের হাত ধরে। তারপর কিশোরী বেলায় এক জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলাম 'লিপিকা'। বইটি হাতে পেয়েই পড়তে শুরু করেছিলাম। শুরু করে শেষ করেছিলাম কয়েকদিনের মধ্যেই। বুঝেছিলাম কি সব ?না ,একেবারেই না। কেবল এক আলোকোজ্জ্বল শব্দ স্রোতের মধ্যে দিয়ে পার হয়েছিলাম গীতিগদ্যের এক একটি ঘাট। মন বলেছিল এ কেমন লেখা? এমন তো আগে পড়িনি ।
'সুয়োরানীর সাধ' 'রাজপুত্তুর' 'পরীর পরিচয়' এ রূপকথা তো এত দিনের পড়া রূপকথার সঙ্গে মেলে না ।আবার এর ঘোরও কাটে না। বোঝা না বোঝায় মিলেমিশে এমন এক মায়াজাল বুনে চলে এর শব্দ ভান্ডার যা পরিচিত জগতের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আরও একটি জগতের হদিস দেয় আভাসে ইঙ্গিতে। বিছানায় মায়ের পাশে শুয়ে খোলা জানালার ঐ পাড়ে দেখা তারাটিকে মনে মনে কতবার বলেছি 'সুখী রানীর মনের দুঃখের কারণ জানিস?' সে কারণ একটু একটু যেন ধরা পড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন যত এগিয়েছে তার সাথে। বয়স যত বেড়েছে 'লিপিকা'কে বুঝেছি অন্য অন্য ভাবে ।আলোর শতদলের মতই এই গ্রন্থের পাতাগুলি একে একে নিজেকে প্রস্ফুটিত করেছে স্তরে স্তরে ।
সুয়োরানী তার স্যাঙাৎনিকে বলেছে "আমার শেষ কথাটি বলি তোমার কানে, ওই দুয়োরানীর দুঃখ আমি চাই। ওর ওই বাঁশের বাঁশিতে সুর বাজল কিন্তু আমার সোনার বাঁশি কেবল বয়েই বেড়ালেম,আগলে বেড়ালেম বাজাতে পারলাম না।" বস্তু সর্বস্ব জীবনে বাঁচতে বাঁচতে বাঁশের বাঁশির সহজ প্রাকৃতিক সুরটুকুর জন্য প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।বুঝতে পারি সারল্যের সুর, প্রাণের আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে ম্যাটেরিয়ালিস্টিক জগত থেকে।
" গাড়িতে উঠবার সময় একটুখানি মুখ ফিরিয়ে সে আমাকে তার শেষ চাউনিটি দিয়ে গেছে। এই মস্ত সংসারে ঐটুকুকে আমি রাখি কোনখানে? দণ্ড পল মুহূর্ত অহরহ পা ফেলবে না এমন একটু জায়গা আমি পাই কোথায় ?মেঘের সকল সোনার রঙ যে সন্ধ্যায় মিলিয়ে যায়, এই চাউনি কি সেই সন্ধ্যায় মিলিয়ে যাবে? নাগকেশরের সকল সোনালি রেণু যে বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় এও কি সেই বৃষ্টিতেই ধুয়ে যাবে? সংসারের হাজার জিনিসের মাঝখানে ছড়িয়ে থাকলে এ থাকবে কেন --হাজার কথার আবর্জনায় ,হাজার বেদনার স্তুপে ?তার ওই এক চকিতের দান সংসারের আর সমস্তকে ছাড়িয়ে আমারই হাতে এসে পৌঁচেছে একে আমি রাখবো গানে গেঁথে ,ছন্দে বেঁধে ;আমি রাখবো সৌন্দর্যের অমরাবতীতে।('একটি চাউনি') প্রেমের এমন গদ্যকবিতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে আজীবন। গানের সুর বলেছে "আমি রাজার প্রতাপকে স্পর্শ করি নে, ধনীর ঐশ্বর্যকেও না কিন্তু ঐ ছোটো জিনিস গুলোই আমার চিরদিনের ধন, ওইগুলি দিয়েই আমি অসীমের গলার হার গাঁথি।"
'পায়ে চলার পথ' ',মেঘলা দিনে' ,'মেঘদুত' ,'প্রথম শোক' ,'বাঁশি','পুরনো বাড়ি,' ইত্যাদি গদ্যকবিতা 'মিনু' 'রাজপুত্তুর' 'সুয়োরানীর সাধ' 'ঘোড়া 'নতুন পুতুল' 'উপসংহার' 'আগমনী' 'রথযাত্রা' 'সওগাত' 'পরিচয়' 'অস্পষ্ট' 'কর্তার ভূত' 'তোতা কাহিনী' ইত্যাদি অখ্যানধর্মী ধর্মী রচনা যতবার পড়েছি ততোবারই তা নতুন অর্থ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। তাই কোনদিনই এ গ্রন্থ পাঠ আমার শেষ হয়নি ।আজীবনের প্রিয় গ্রন্থ হয়ে থেকেছে ১৯২২ সালে ৩৯টি কথিকা নিয়ে প্রকাশিত লিপিকা।
'তোতা কাহিনী'র বিপর্যস্ত পাখিটিকে আজও আমরা বিরাট সিলেবাসের আড়ালে চাপা পড়া শৈশবের মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করি।গতানুগতিক প্রশানিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রত্যক্ষ করি 'কর্তার ভূত'কে। কাঞ্চির রাজার মধ্যে দেখি প্রশাসনের রক্তলোলুপ স্বৈরাচারী রূপ। তাই এ লেখা কখনো প্রাসঙ্গিকতা হারায় না।
এ লেখা চিরকালীন হয়ে আছে তার প্রেমের অনুপম শব্দবন্ধে। কেজো মানুষের স্বর্গে প্রেম এসেছে বেকার চিত্রশিল্পীর হাত ধরে। শিল্পী এক ব্যস্ত মেয়ের কাছ থেকে তার জল ভরার ঘড়াটি চেয়ে নিয়ে নকশা এঁকে দিলে মেয়েটি শিল্পের অহেতুক আনন্দের মধ্যেই নিজের অজান্তে স্পর্শ করেছে প্রেমকে ।" সবার চোখের আড়ালে বসে সেটিকে সে নানা আলোতে নানা রকমে হেলিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। রাত্রে থেকে থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে দীপ জ্বেলে চুপ করে বসে সেই চিত্রটা দেখতে লাগল। তার বয়সে এই প্রথম সে এমন কিছু দেখছে যার কোনো মানে নেই।তার পরদিন যখন সে উৎস তলায় এল তখন তার দুটি পায়ের ব্যস্ততায় একটু যেন বাধা পড়েছে। পা দুটি যেন চলতে চলতে আনমনা হয়ে ভাবচে - যা ভাবছে তার কোনো মানে নেই।"(ভুল স্বর্গ)
দিন যত এগিয়েছে এ বই কখন লেখা হলো, কিভাবে লেখা হলো, কবির মনের অবস্থা তখন কেমন ছিল এসব জানতে চেয়েছে মন।রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার সুবাদে জেনেছি রবীন্দ্র মানস এ গ্রন্থ রচনার আগে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল নানা কারণে। কিছুটা অবসাদগ্রস্ত ছিলেন কবি। শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না।তার ওপরে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের(১৩ইএপ্রিল ১৯১৯) প্রতিবাদ করতে চেয়েও কাউকে পাশে পাচ্ছিলেন না একলাই চলতে হয়েছিল তাঁকে। অবলীলায় ত্যাগ করেছিলেন ইংরেজদের দেওয়া নাইটহুড উপাধি(৩০শে মে,১৯১৯)
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ স্মৃতিকথায় লিখেছেন
"তারপর যেদিন নাইটহুড ছাড়ার চিঠি পাঠিয়ে দিলেন সেইদিন থেকে নিশ্চিন্ত। সকালবেলা আমি চিঠিখানা নিয়ে গেলাম আর বিকেলে এসে দেখি তেতলার ঘরে চলে গিয়েছেন ।ঘরে ঢুকতেই একটা ছোট্ট লাল খাতা আমায় দিয়ে বললেন,' এই নাও আর একটা লেখা'। দেখি, 'বাপ শ্মশান হতে ফিরছে' ওইটা লিখেছেন। এইটাই 'লিপিকা'র প্রথম লেখা ।তারপর ক'দিনের মধ্যেই হুড়মুড় করে সমস্ত বইখানা লেখা হয়ে গেল ।কবি স্বয়ং লিখেছেন "বেশ মনে আছে দিনের-পর-দিন লিপিকা লিখছি কোথায় গেছে জালিয়ানওয়ালাবাগ ,কোথায় গেছে পলিটিক্স ।আমার আর কিছুই মনে নেই ।কেবল লেখার মধ্যে ডুবে রয়েছি। ভাষা কী ! একেবারে নতুন চেহারা নিয়েছে। আশ্চর্য ! কোথা থেকে এলো এ রকম ভাষা? আমি অনেকবার দেখেছি কোন কিছু একটা নিয়ে মনটা বড্ড বেশি নাড়া খেলেই তারপর আমার লেখা বেরোয় ।"
আশ্চর্য ভাব আর অপরূপ ভাষার স্বাতন্ত্র্যে লিপিকা রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রদীপ্ত হয়ে আছে। গঠনের দিক থেকে রচনাগুলি অনন্য,অভিনব। লিপিকার প্রতিটি রচনাই পাঠককে পৌঁছে দেয় অন্য এক বোধের কাছে। এমন লেখা রবীন্দ্রসাহিত্যে বিরল। জীবনের চড়াই-উৎরাই পেরোতে পেরোতে এ লেখা আমার একান্ত আশ্রয় হয়ে উঠেছে। সারা জীবন যার হাত ধরে থেকে পথ চলার শক্তি পাই, যা আমাকে দেয় মনের আনন্দ,প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি।