কাওয়াবাতার ইন্দ্রধনু উপন্যাস প্রসঙ্গে

কাওয়াবাতার 'ইন্দ্রধনু' (জাপানী ভাষায় নাম নিজি) উপন্যাসটি জাপানী ভাষা থেকে বিশ্বের অন্য ভাষাগুলির মধ্যে প্রথম অনূদিত হয়েছিল বাংলা ভাষাতেই। এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় এই মাত্র দু বছর আগে ২০২৩ সালে। অথচ ১৯৬৯ এই বেরিয়েছিল বাংলা অনুবাদ। এর সঙ্গে জড়িত আছে এক কৌতূহলউদ্দীপক কাহিনী। ১৯৬৮ সালে কাওয়াবাতা রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয় এশীয় হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেই সারা বিশ্বের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতের তাঁকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। তখনো অবধি কাওয়াবাতা সেভাবে বাংলা ভাষাতে অনূদিত হন নি। ইংরাজীতেও কয়েকটি মাত্র অনুবাদ বেরিয়েছে। বাঙালি পাঠকদের জন্য কাওয়াবাতার একটি অনুবাদ বের করার চিন্তা করেন দেশ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ। দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষ মশাই এই দায়িত্ব দেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানী ভাষা সাহিত্যের জাপানী অধ্যাপক কাজুও আজুমাকে। বলেন এমন একটি অনুবাদ তাঁরা সরাসরি  জাপানী ভাষা থেকে বাংলায় প্রকাশ করতে চান যা ইংরাজীতে এখনো অনূদিত হয় নি। কাজুও আজুমা সরাসরি যোগাযোগ করেন কাওয়াবাতার সঙ্গে। কাজুও আজুমাকে কাওয়াবাতা বলেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হবে, এটা শুনে তিনি খুব খুশি। কাজুও আজুমাকে তিনি নিজি নামের উপন্যাসটি অনুবাদ করার অনুমতি দেন ও জানান এটি ইংরাজীতে তো বটেই, বিশ্বের অন্য কোনও ভাষাতেই তখনো অবধি অনূদিত হয় নি, কেবলমাত্র জাপানী ভাষার মূল টেক্সটিই উপলব্ধ। কাজুও আজুমা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যকে নিয়ে এই অনুবাদ কর্মটি সম্পন্ন করেন। ১৯৬৯  সালের জুন মাস থেকে এটি দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি সংখ্যা ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বই হিসেবে সেসময় বেরোয় নি। অবশেষে কাওয়াবাতার জন্ম শতবর্ষের সময় ১৯৯৯ সালের ১৪ অগস্ট কাওয়াবাতার জন্মদিনে এটি মডেল পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত হয়। অনুবাদকদ্বয় সেখানে ছোট্ট একটি ভূমিকা লিখে এই অনুবাদ সম্পর্কে সেখানে জানান, এই মহান্ স্রষ্টা আমাদের জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে নিজেই তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির মধ্যে নিজি উপন্যাসটিকে আংলার তরজমার জন্য মনোনীত করে দিয়েছিলেন; রবীন্দ্রনাথের দেশ থেকে আমাদের লেখা চিঠি পেয়ে তিনি খুশি হয়েছিলেন।”

কাওয়াবাতা তাঁর 'ইন্দ্রধনু' উপন্যাসের স্বল্পায়তন পরিধিতে দেখান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানে সেখানকার প্রথানুগ নাট্যদলের ক্ষরণ যন্ত্রনার কথা৷ টোকিওর একটি নৃত্যনির্ভর জাপানী নাটকের দলের কুশীলবরাই এই উপন্যাসের মূল চরিত্র। কাওয়াবাতার অনেক লেখাতেই জাপানের ঐতিহ্য বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে কীভাবে সঙ্কটে পড়ছে তা ঘুরে ফিরে আসে। হাজার সারস উপন্যাসে আমরা দেখি সেখানে চা মিলনীর ঐতিহ্যসম্মত প্রথাটির মধ্যে কীভাবে কলুষ প্রবেশ করছে, আর ইন্দ্রধনু উপন্যাসে রয়েছে ঐতিহ্যের জাপানী থিয়েটারের সঙ্কটকালীন ছবি।

'ইন্দ্রধনু' উপন্যাসের চরিত্রদের সম্পর্কে যেটুকু তথ্য লেখক দিয়েছেন তা পরিমাণে অল্প কিন্তু গভীর ইঙ্গিৎবাহী। যেমন নাট্য দলটির পরিচালক নিসিবায়াসি সম্পর্কে। লেখক জানান নিসিবায়াসি মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করেন, প্রসঙ্গ তোলেন।

নিসিবায়াসি জানতে চান, “সকাল আর সন্ধ্যের মধ্যে কোন সময়ের আকাশের রঙ তোমাদের পছন্দ?” সন্ধ্যের সময় কোতোতোই বাঁধ পেরিয়ে সুমিদা পার্কের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে নাট্য পরিচালক নিসিবায়াসি এ প্রশ্ন করেছিলেন।  প্রশ্ন করার স্থানকালটিকেও লেখক জানিয়ে যান। বাঁধানো পথের দু ধারে চেরি ফুলের গাছে এসেছে নতুন পাতা। নদীর তীর থেকে ওপারের দূরের পাহাড়টাকেও দেখা যায়। আমরা বুঝতে পারি এই নাট্য পরিচালক জীবন আর প্রকৃতির বৃহত্তর রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে অভিনয়কে মেলাতে চান।

একদিন তিনি নাটকের দলের ছেলেমেয়েদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কার মানি ব্যাগে কত টাকা আছে তা কেউ না গুণে বলতে পারে কীনা। আয়াকো বলে সে সঠিক অঙ্কটা বলতে পারবে। বাকীরা জানায় তারা জানে না কার ব্যাগে ঠিক কত টাকা আছে। গিনকোর উত্তরটা ছিল একেবারে আলাদা। সে বলে যে এসব হিসেব সে রাখে না, আকাশের গায়ে রামধনু দেখতেই তার সবচেয়ে ভালোলাগে। উপন্যাসের একেবারে শেষদিকে এসে কিমুরা জানায়, “নাটকের কাজ ছেড়ে দেব ভাবছি, এর চেয়ে বিমানের চালক হয়ে আকাশে রামধনুর মধ্যে দিয়ে উড়ে যেতেই আমার বেশি ইচ্ছে করে।”

আয়াকোর বাবা জ্যোতিষচর্চা করে সংসার চালান। তবে তার অল্প আয়ে দিন চলে না বলে নাটকের দলে কাজ করা মেয়ের কাছ থেকে তিনি মাঝে মাঝেই টাকা পয়সা নিতে আসেন। তার স্মৃতিচারণে এই নাটকের কারবার যে এলাকায় সেই আসাকসার পুরনো ছবিটা ফুটে উঠেছে। “সে সময়টা ১৮৯৭ কি ওরকম কিছু হবে। তখনকার পথে ঘাটে হাতে টানা রিকশাই ছিল বেশি। আর সেদিনের রিকশাওয়ালারা আজকালকার ট্যাক্সি ড্রাইভারদের তুলনায় বরং বেশিই রোজগার করতো। তা সত্ত্বেও সেই রিকশাওয়ালারা ক্রমে বেশ্যাপল্লীতে খদ্দের জোগাড়ের কাজে হাত দিলে। তারপর ধীরে ধীরে বেশ্যাবাড়ির মালিক হয়ে একবার হাজতে একবার বাইরে – এইভাবে তারা দিন কাটাতে লাগলো।”

উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে এক তরুণ, যার নাম কিমুরা। তাঁর সমবয়সী অভিনেত্রীরা - আয়াকো, ছোওকো, ফুজিকো সকলেই তাকে ভালোবাসে৷ ছোওকো ও ফুজিকো খানিক লাস্যময়ী, বাইরের পুরুষদের সঙ্গেও ভাব জমাতে পটু। কেউ যদি সাংবাদিকদের প্রশ্রয় দেয় তবে কেউ আবার কিমুরাকে আধা রসিকতা আধা আশ্লেষে চুম্বন করে। অন্যদিকে আয়াকোর মধ্যে গভীরতা ও করুণার দীপ্তি বেশি।

তবে নারী চরিত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট রানকো আর গিনকো। এগারো বছরের বালিকা হানকোরও আছে অনেক চমক লাগানো অভিব্যক্তি। এগারো বছরের বালিকা সদ্য নারী পুরুষ সম্পর্কের রসায়ন বুঝতে শুরু করেছে আবার ছেলেমানুষি করে সে সরাসরি কিমুরার প্রতি তার ভালোবাসা জানাতে বা তার বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়তে লজ্জাবোধ করে না। নানা নাটকের দলের মধ্যে সে ঘুরে বেড়ায় আর এক দলের খবর অন্য দলের কাছে চালান করে। তার মাধ্যমেই আয়াকো, ছোওকো, ফুজিকোরা কিমুরার প্রতি তাদের আধা গোপন প্রেমকে প্রকাশ করে। এদের সঙ্গেই উপন্যাসটিতে নাকানে আর নিসিবায়াসি - যথাক্রমে নাচের দলের পরিচালক আর নাটকের দলটির সামগ্রিক পরিচালকও রয়েছেন দুই চরিত্র হিসেবে। এই দুই চরিত্রর দুর্ভাবনার কথা দিয়েই শুরু করা যাক আমাদের আলোচনায় না৷ তাঁরা ভাবছেন কীভাবে দলটিকে আদৌ টিকিয়ে রাখা যাবে ঐতিহ্যবাহী নাটকের সঙ্কটের এই দিনকালে৷ 

একদিকে যখন সিনেমা হলের সামনে লম্বা লাইন তখন নাটকের শোয়ে দর্শক হয় না। নাটক শুরুর আগে কর্তাব্যক্তিরা প্রেক্ষাগৃহের সামনে হাজির হয়ে আশেপাশের জনসমাজের কাছে কাতর আবেদন জানান, যেন তাঁরা টিকিট কেটে নাটক দেখতে আসে। কিন্তু সে আবেদন শেষমেষ নিস্ফল প্রতিপন্ন হয়৷ দিনের পর দিন শূন্য প্রেক্ষাগৃহে কোনও রকমে টিঁকে থাকে ঐতিহ্যের ক্ষীণ করুণ ধারাটি। কাওয়াবাতা গোটা উপন্যাসজুড়ে একদিকে যেমন সঙ্কটের নানা ছবি তৈরি করেন, তেমনি তার ফাঁকে ফাঁকেই উঁকি দিয়ে যায় প্রেম ভালোবাসার মায়াবী মুহূর্তগুলি।

পঞ্চম অধ্যায়ের শুরুতেই পাই নাটকের দলের দর্শক সঙ্কটের একটা স্পষ্ট ছবি। -

“রঙ্গালয়ের প্রধান ফটকের মাথায় ছিলো একটা চওড়া কার্নিস। মঞ্চ থেকে চারজন অভিনেতা বেরিয়ে এসে সেই কার্নিসের ওপরে কোনওরকমে উঠে পড়লো। তাদের মধ্যে যাকে বেশ নায়কের মতো দেখাচ্ছিলো, সে সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করে দিলে। তার বক্তব্য, আজও নাটক দেখানর জন্য যথারীতি মঞ্চের পর্দা তোলা হয়েছে, কিন্তু দর্শকের সংখ্যা এতই কম যে, নাটক শুরু করাই সম্ভব হচ্ছে না। আমরা সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে অভিনয়ের পোশাকেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। আপনারা যাঁরা নাটক ভালোবাসেন তাঁদের কাছে আমরা কাতরভাবে সহানুভূতি প্রার্থণা করছি। আপনাদের সাহায্য আর সহানুভূতি না পেলে শেষ পর্যন্ত আমাদের মঞ্চের ভেতরেই বসে বসে মরতে হবে।”

এই সঙ্কটের ছবিটি তুলে ধরার পর গল্পকথক নিজ মন্তব্যে পাঠককে জানান, “শ্রমিক ধর্মঘট বা স্বাধীনতা সংগ্রামে দলের নেতারা যেভাবে বক্তৃতা দিয়ে থাকে, ওদের কথা বলার ধরনধারণও ছিল অনেকটা সেই রকম। বক্তৃতার শেষে রাস্তার লোকজনকে আকৃষ্ট করার জন্য তারা সেই কার্নিসের ওপর দাঁড়িয়েই তাদের নিজেদের কিছু কিছু খেলা দেখালে।

একেবারে চৌরাস্তার মোড়ের ওপর এই রঙ্গালয়। চারটি রাস্তার সব কটিই অবশ্য অত্যন্ত সরু সরু। নাট্যঘরের ফটকের সামনে এই বিনে পয়সার খেলা দেখতে বেশ ভিড় জমে গেছে। ফটকের ঠিক উলটো দিকেই একটা রেস্টুরেন্ট, গরীব লোকেরা এখানে এসে ভাত খায়। এই রেস্টুরেন্টের চাকরানিগুলোও খেলা দেখতে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।

গ্রীষ্মকালে এসব পাড়ায় খুব কম লোকই থিয়েটার দেখতে আসে। এ সময় নাটকের বাজারে যে কতখানি মন্দা চলে তারই এক বিষণ্ণ উদাহরণ হিসেবে এই রঙ্গালয়ের ঘটনাটি পরের দিনের খবরের কাগজে রীতিমতো বড়ো আকারে ছাপা হলো। নাটকের লোকেরা বাইরে এসে খেলা দেখিয়েও কিন্তু কোনও দর্শক সংগ্রহ করতে পারলো না। অবস্থা বুঝে দলের লোকেরা আস্তে আস্তে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো। কেবল কতকগুলো পুরনো বিজ্ঞাপনের ছবি নাট্যশালার বাইরের দেওয়ালে ঝুলে রইলো। আসাকসা এলাকায় আমোদপ্রমোদের জন্য যেখানে প্রতি দিন বহু লোক জমা হয়, তেমন জায়গায় দাঁড়িয়ে এই পুরনো জীর্ণ বিজ্ঞাপনের ছবিগুলির দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই নাট্যশালার দশা কেমন শেষ হয়ে এসেছে।”

রানকো নাটকের সঙ্কটগ্রস্থ দিনকালের প্রতিনিধি। সে এক সময়ে নামকরা অভিনেত্রী ছিল, কিন্তু সেই সব সোনালি দিন অনেককালই অতীত। এখন তাঁর অভিনয় দেখতে কেউ আসে না। সে হঠাৎই একদিন নিসিবায়াসির থিয়েটার ছেড়ে চলে যায় এক ভ্রাম্যমাণ দলের সঙ্গে নাটক করতে। কিন্তু তার উচ্চাশা ব্যর্থ হয়। সে সেই ভ্রাম্যমাণ দল ছেড়ে আবার ফিরে আসতে বাধ্য শহরে, যদিও পুরনো দলে যোগ দেয় না। তিক্ত মনে ও ক্রুর দৃষ্টিতে সে কেবল সেখানকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। যে কিমুরাকে সে এই দলে এনেছিল সে এখানে সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে, তার ঘরেই থাকছে অন্য এক নারী গিনকোর সঙ্গে। তার অতীত আর বর্তমান শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলে না, থিয়েটারের ওঠাপড়ার কথাও বলে।

এই আসাকসা এলাকাতেই শিল্পী হিসেবে রানকোর একদিন বেশ নামডাক ছিল, সকলেই খাতির যত্ন করতো। কিন্তু দর্শকমহলে আজ আর তার কোনও চাহিদাই নেই। এর ওপর শহরের বাইরে চলে যাওয়ায় তার কথা সকলে প্রায় ভুলেই গেছে। প্রকৃতির ঋতু বদলের মতোই কখন যে জনপ্রিয়তা আসে আর চলে যায় – বোঝবার উপায় নেই। বেশ কিছু দিন পর টোকিওয় ফিরে এসে রানকো যখন পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা করতে কিংবা কোনও কাজের সন্ধানে এর ওর কাছে যায়, তখন তাকে নিতান্ত অসহায় মনে হতে থাকে।

গরীব লোকেরা যেমন ফসল কাটার শেষে জমি থেকে খুঁটে শস্যকণা তোলে, রানকোও প্রায় সেইভাবে এক একটি লোক কোনওরকমে সংগ্রহ করে তার নাট্যদলটি খাড়া করেছে। ফলে এরকম দল যে খুব বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকবে, তা কখনোই আশা করা চলে না। তাই আসাকসায় রানকো পুরোপুরি ফিরে এসেছে বলার চেয়ে সে শহরে কয়েকদিন বিশ্রাম করতে এসেছে বলাই বরং ভালো।”

গিনকো এই উপন্যাসের সবচেয়ে সংবেদনশীল অনুভূতিমাখা মুহূর্তগুলি তৈরি করে। তার কাছে এসেছে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব, তারকা হয়ে ওঠার সুযোগ। কিন্তু সে সব সে হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছে৷ তার কোনও উচ্চাশা নেই। নেই কোনও চীৎকৃত প্রতিবাদ। রানকো তাকে আঘাত করে রক্তাক্ত করলে বা তার যৌনজীবনের দিকে ইঙ্গিৎ করে খারাপ মন্তব্য করলেও সে প্রতিবাদ প্রত্যুত্তর করে না। আশ্চর্য এক সহনশীলতা আর নিস্পৃহতার চাদরে সে মোড়া থাকে। কিমুরাকে সে গোপনে ভালোবাসতো কীনা তাও আমরা তা জানি না। সে কিমুরার সঙ্গে একই ঘরে থেকেছে দিনের পর দিন কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি। গিনকো ফিরে আসার পরেও তারই ছেড়ে যাওয়া ঘরে আবার সে কিমুরার সঙ্গে থাকতে যায়। বাকীরা এতে অবাক হলেও সে নিস্পৃহ।

আয়াকোর সঙ্গে তার কথোপকথনটি লক্ষ করা যাক –

“গিনকো আজ রাতে তুমি কোথায় থাকবে কিছু ঠিক করেছো?

আমি কিমুরার কাছেই যাবো।

রানকোর ফিরে আসার পরেও!

হ্যাঁ” – ‘গিনকো সরাসরি এভাবে উত্তর দেওয়ায় আয়াকো অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এরপর নাচের দলের পরিচালক নাকানে গিনকোকে প্রশ্ন করা শুরু করেন। -

“তুমি কি ওখানে প্রায়ই যাও?

গিনকো এ কথার কোনও উত্তর দেয় না।

কিমুরাকে কি তুমি সত্যি সত্যিই ভালোবাসো নাকি?

আমি জানি না।

গোপন কোরো না।

সত্যিই বলছি।

তা হলে রাত্রে ওহানে কেন যাও?

কাউকেই আমি ভালোবাসি না। কথাটা বলতে বলতে গিনকোর গলা আটকে আসে। নাকানে দেখেন গিনকোর চোখ জলে ভরা।”

তবে উপন্যাসের শেষে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকার মতো মত করে তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কোমাকো একদা জানিয়েছিল তার সবচেয়ে ভালো লাগে ঘুমিয়ে থাকা কোনও নারীকে দেখতে। সে কথা মনে রেখেই গোপন দয়িতের সামনে সে কি মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শান্তিতে চির ঘুমের এক ছবি তৈরি করে দিয়ে গেল? এর স্পষ্ট কোনও উত্তর উপন্যাসে নেই, তবে এরকম এক অস্পষ্ট ইঙ্গিৎ আছে। 

কোমাকো এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে একদা পাতাল রেলে কন্ডাক্টারের চাকরী করত। সে কাজ করতে তার ভালো লাগত না বলে সে চলে এসেছিল থিয়েটারের জগতে। অনুশীলনে খুব মনোযোগী না হলেও স্টেজ পারফর্মান্সেসগুলো সে ভালোভাবেই উৎরে দিত। থিয়েটারে সঙ্কট আসার পর সে কিন্তু দমে গেল না। রানকোর মতো তিক্ত হয়ে উঠল না, গিনকোর মতো জীবনকে চিরবিদায়ও জানাল না। সে ইন্দ্রধনুর মতো বর্ণময় হয়ে উঠতে চাইলো। ইন্দ্রধনু চকিতে ভেসে ওঠে, চকিতে মিলিয়ে যায়। আমাদের মনে রাখতে হয় কাওয়াবাতার মতো ওয়াবী সাবির দর্শনে বিশ্বাসীদের কাছে সৌন্দর্যের ক্ষণ মুহূর্তও বিরাট প্রাপ্তি। অপূর্ণতা বা ত্রুটিও নান্দনিকভাবে গ্রহণীয়। তারই প্রকাশ রয়েছে কোমাকোর ভাবনায়, তার চরিত্রচিত্রণে।