কাওয়াবাতার উপন্যাস 'সহস্র সারস' প্রসঙ্গে

কিকুজি নামের এক সদ্য যুবকের মৃত পিতামাতার স্মৃতি, প্রেম, যৌনতা, অস্থিরতার কথা আছে ইয়ুসুনারি কাওয়াবাতার ‘থাউজেন্ড ক্রেনস’ নামের উপন্যাসটিতে।

কিকুজির বাবা বরিষ্ঠ মিতানী মারা যাবার পর তার মা একা হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য স্বামী বেঁচে থাকার সময়েও তাঁকে তিনি অন্য নারীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে সেই নিয়ে তাঁর কতটা অনুযোগ বা বেদনা ছিল তার বিশদ কোনও পরিচয় এই উপন্যাসে নেই। তবে বরিষ্ঠ মিতানীর সঙ্গে যে দুই নারীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তাদের বিস্তারিত উপস্থিতি এই উপন্যাসে আছে। এই দুই নারীর একজন হলেন চিকাকো কুরামতো। খুব অল্পদিনের জন্য তার সঙ্গে বরিষ্ঠ মিতানীর একটি প্রেম সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তবে তার থেকে সরে এরপর শ্রীমতি ওতার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন বরিষ্ঠ মিতানী। তার মেয়ে ফুমিকো বালিকা বয়সেই নিজের বাবাকে হারিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই মায়ের সঙ্গে বরিষ্ঠ মিতানীর এই সম্পর্ককে কাছ থেকে দেখেছে সে। যুদ্ধের দিনগুলিতে সে বরিষ্ঠ মিতানীকে অনেকটা দূর অবধি বাড়ির পথে এগিয়ে দিত সেই বালিকা বুসেই। একবার বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে নিজে আর ফেরার সুযোগ পায় নি। রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছিল রাস্তার মাঝে থাকা এক যুদ্ধকালীন আশ্রয়গৃহে। কিকুজীর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় বরিষ্ঠ মিতানীর মৃত্যুর প্রায় চার বছর পরে, চিকাকো কুরামতোর বাড়ির এক চা মিলনীতে। সেই চা মিলনীতে চিকাকো, কিকুজি ছাড়াও হাজির ছিলেন শ্রীমতি ওতা, তার মেয়ে ফুমিকো আর য়ুকিকো ইনামুরা নামের এক কিশোরী যার কাছে থাকা এক কাপড়ে রয়েছে সহস্র সারসের ছবি। এই চা মিলনী আর সহস্র সারস প্রসঙ্গ দুটি এই উপন্যাসের দুটি কেন্দ্রীয় বিষয়, প্রধান চরিত্রদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলির তাৎপর্য জানা এই উপন্যাসকে বোঝার অন্যতম শর্ত। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে আমরা কাহিনী ও চরিত্রদের দিকে আরেকটু মন দিই।

উপন্যাস শুরু হয় চিকাকোর বাড়িতে আয়োজিত চা মিলনীর উল্লিখিত আয়োজন দৃশ্যটি দিয়ে। এখানেই উপন্যাসের মূল চরিত্রদের অনেকে পরস্পরকে প্রথম চাক্ষুস দেখে। অনেকে আবার অনেক বছরের পূর্ব পরিচিত। পুরনো পরিচয় ও সম্পর্কের কথা যেমন এরপর উপন্যাসে মাঝে মাঝে ফিরে আসে, তেমনি নতুন পরিচয়গুলি থেকে নতুন ঘটনাক্রম ও চরিত্রপাত্রদের নতুন বিন্যাস এগোতে থাকে। চা মিলনীটি চলাকালীনই আমরা জানতে পারি চিকাকো চায় কিকুজির সঙ্গে ইনামুরাদের কিশোরী মেয়ে য়ুকিকোর একটা সম্পর্ক তৈরি করে দিতে। এই আকাঙ্ক্ষা থেকে চিকাকো এর পরেও য়ুকিকোকে নিয়ে আসে কিকুজিদের বাড়িতে। সেই পর্বে য়ুকিকোর প্রতি কিকুজির একটি আকর্ষণও তৈরি হয়, কিন্তু সে কোনও পাকা সম্পর্ক বা বিয়ের সম্ভাবনাকে অন্তত মুখে নাকচ করে দেয়।

চা মিলনী থেকে ফেরার পথে ঘটে এক নাটকীয় ও প্রভাবসঞ্চারী ঘটনা। বাবার অনেকদিনের প্রণয়িনী শ্রীমতি ওতা মেয়ে ফুমিকোকে এগিয়ে যেতে বলে অপেক্ষা করেন দয়িতের সন্তান কিকুজির জন্য। তাকে নিয়ে আসেন এক সরাইখানায় এবং সেখানে সদ্য কুড়ি পেরনো কিকুজির সঙ্গে মধ্যে চল্লিশের এই নারী শরীরী সম্পর্ক স্থাপণ করেন। এই অকস্মাৎ যৌনতা এরপর থেকে কিকুজিকে একইসঙ্গে আশ্লেষ ও যন্ত্রণায় ভরিয়ে রাখে। যন্ত্রণা সঙ্গী হয় শ্রীমতি ওতারও, বিশেষ করে যখন তিনি জানতে পারেন যে চা মিলনীটির পর এই যৌন সম্পর্ক তৈরি হল সেখানে কিকুজির সাথে য়ুকিকো ইনামুরার পাকাদেখার ব্যবস্থা করেছিলেন চিকাকো। কেন শ্রীমতী ওতা এই অসম বয়সী ও আশ্চর্য যৌনতায় জড়িয়েছিলেন? তিনি কি পুত্র কিকুজির মধ্যে তার পিতা ও নিজ প্রেমিক বরিষ্ঠ মিতানীকে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন? নাকী নিজের একাকিত্বের যন্ত্রণাকে আর ঠেকাতে না পেরে এই অসম সম্পর্কের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন? কারণ যাই হোক এই যৌনতা তাকে যন্ত্রণা ও পাপবিদ্ধ করে এবং শেষ একবারের মতো কিকুজির সঙ্গে দেখা করার পরেই তিনি বাড়ি ফিরে আত্মহননের পথ বেছে নেন। নিজের মেয়ের কাছেও এই পাপবিদ্ধ যন্ত্রণাকে তিনি সম্ভবত লুকিয়ে রাখেন নি। মায়ের মৃত্যুর পর ফুমিকো কাকুজিকে বারবার বলেছে সে যেন তার মাকে ক্ষমা করে দেয়। কাকুজি নিজেও এই অকস্মাৎ যৌনতার গ্লানিতে অনেকদিন অবধি আবদ্ধ ছিল। তবে ধীরে ধীরে ফুমিকোর সঙ্গে তার একধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। সেই সম্পর্ক তার বাড়িতে একরাতে যৌন সংযোগ অবধি পৌঁছয়। ফুমিকোর সঙ্গে সহজ সম্পর্ক ও তার পরিণতিতে আসা পারস্পরিক সেই স্বেচ্ছা যৌনতা কাকুজিকে যখন আগের অপরাধবোধ থেকে খানিক মুক্তি দিচ্ছে, তখনই ফুমিকোর সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চেনা ঠিকানাগুলিতে অনেক অনুসন্ধান করেও তার কোনও খোঁজ পায় না কাকুজি। উপন্যাস যখন শেষ হয় তখনো কোনও চিরস্থায়ী সম্পর্কে স্থিত হতে পারে না কাকুজি। তবে যে ওয়াবি সাবির দর্শন জাপানী সাহিত্যে বারবার ফিরে ফিরে আসে, তাতে বিশ্বাসী কাওয়াবাতা দেখান যা অপূর্ণ ও ক্ষণস্থায়ী, তার মধ্যেও এক অসামান্য সৌন্দর্য ও গভীরতা আছে। কাকুজি ফুমিকোর সম্পর্কটি যদি পদ্মপাতার জলের মতো ক্ষণস্থায়ীও হয়, তবুও সেই প্রেমের সৌন্দর্য ও গভীরতা কমে না।

চিকাকো চরিত্রটিকে যদি প্রচলিত খল হিসেবে নাও দেখি, তবুও বলতে হয় সে খানিক তিক্ত বাস্তবতাকেই এখানে আভাসিত করে। বরিষ্ঠ মিতানী স্বল্প দিনের সম্পর্কের পর তাকে ছেড়ে শ্রীমতি ওতার কাছে চলে গিয়েছিলেন, এজন্য তার ঈর্ষা ও বিদ্বেষ অস্বাভাবিক নয়। সে মিতানীর স্ত্রীকে শ্রীমতি ওতা বিষয়ে যেমন ব্যর্থ অভিযোগ জানায়, তেমনি বরিষ্ঠ মিতানী পুত্র কাকুজির কাছেও শ্রীমতি ওতা সম্পর্কে ধারাবাহিক অনুযোগ জানিয়ে যায়, বিষ ছড়াতে চেষ্টা করে। এমনকী শ্রীমতি ওতার মৃত্যুর পরেও তা বন্ধ হয় না। সে কাকুজিকে বোঝাবার চেষ্টা করে শ্রীমতি ওতার আত্মহত্যাও হল এক অন্তিম কৌশল, নিজের মেয়ে ফুমিকোকে অনাথ অসহায় প্রতিপন্ন করে তার প্রতি কাকুজির সহমর্মিতা ও আকর্ষণ তৈরির চেষ্টা এর মধ্যে অভিব্যক্ত। মৃত শ্রীমতি ওতার প্রতি এসব কথা যে কাকুজির পছন্দ নয়, তা সরাসরি জানার পরেও সে দমে না। তার একমাত্র লক্ষ্য কাকুজি ফুমিকো সম্পর্কে যেন তেন প্রকারেণ বাধা তৈরি করা। এজন্য কাকুজি ফুমিকোর মাঝে সে য়ুকিকোকে ঠেলে দিতে চায় জোর করে। কাকুজির কাছে ফুমিকোর বিয়ে হয়ে যাবার মিথ্যে গল্পও ফাঁদে। কাকুজি চিকাকো চরিত্রের নেতিবাদী প্রবণতা সম্পর্কে অবহিত থেকেও এতদূর মিথ্যা সে বলতে পারে তা কল্পনা করতে পারে নি। এই মিথ্যাকে সে বিশ্বাসও করে বসেছিল। ফুমিকোর থেকে সত্যাসত্য জানার পরেই কেবল কাকুজি বুঝতে পারে চিকাকো কতটা অন্ধকারে ঢাকা। কাওয়াবাতা চিকাকোকে আরো অন্ধকারের মানুষ হিসেবে দেখান চা মিলনীকে কেন্দ্র করে।  যে উৎসবটি পবিত্রতা ও ঐতিহ্যের বার্তাবাহী তাকে চিকাকো কলুষিত করে নিজের হীন ও ব্যক্তিগত মনোবাসনা পূরণের মাধ্যম করে তোলার মধ্যে দিয়ে। এমনকী চা মিলনীর রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য করে সে এমনভাবে চা পরিবেশন করে যে মনে হয় কোনও রেস্তোরাতে যেন কোনও পানীয় খদ্দেরকে দেওয়া হচ্ছে। চা মিলনীর সূক্ষ্ম নিয়মনীতিকে সে বারবার ভাঙে।

চা মিলনীর এই বিকৃতি শুধু চিকাকোর অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগৎকে তুলে ধরার জন্যই এই উপন্যাসে আসে নি, এর মধ্যে দিয়ে জাপানের ঐতিহ্য পরম্পরার লঘুত্বের বিপদটি কাওয়াবাতা আভাসিত করতে চান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ পরাজয়ের পর জাপান যখন কার্যত মার্কিন নির্দেশিকার বেড়াজালে বন্দী, তখন সেখানে অন্যান্য নানা বিপদের সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলার সংকটটি দেখা দেয়। প্রায় একশো বছর আগে মেইজি যুগে পশ্চিমের সঙ্গে যে মেলামেশা শুরু হয়েছিল তা অনেকটাই ছিল জাপানবাসীর নিজস্ব রাজনৈতিক প্রতিনিধির নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যে পশ্চিমী হাওয়া এল তা হয়ে দাঁড়াল বাধ্যতামূলক ও নিয়ন্ত্রণবিহীন। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্কট কাওয়াবাতা অনুভব করলেন আর দেখালেন চা মিলনীর মতো একটি ঐতিহ্যশালী দার্শনিক রীতিনীতি সম্মত জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক দিকের অবনমনের মধ্যে দিয়ে। এই উপন্যাসের বরিষ্ঠ প্রজন্মটি যত্ন সহকারে চা মিলনীর রীতিনীতি শিখেছে ও নিয়মিত চা মিলনীর আয়োজন করেছে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম এই চা মিলনীর নিয়মগুলি শেখে নি ও এই সম্পর্কে যথেষ্ট উৎসাহীও তারা নয়। নবীন প্রজন্মের যে চরিত্রটি যত্ন করে চা মিলনীর রীতিনীতি শেখে সেই য়ুকিকো এই উপন্যাসে আসে প্রায় এক প্রতীকের মতো। তার সঙ্গের বস্ত্রখণ্ডটিতে রয়েছে সহস্র সারসের ছবি, যা জাপানের লোককথায় সমস্যা কাটিয়ে ওঠার শুভ ইঙ্গিৎ। য়ুকিকো তার নীরব উপস্থিতি দিয়ে ঐতিহ্য রক্ষার সঙ্গে শুভবোধের সম্পর্কটিকে বাঙ্ময় করে তোলে।

বাঙালি পাঠকের সৌভাগ্য মূল জাপানী ভাষা থেকে জাপানী স্ত্রী এইকো ঠাকুরের সঙ্গে মিলে জাপানের ওসাকা শহরে বসে করা সন্দীপ ঠাকুরের একটি চমৎকার অনুবাদ সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে, যা একইসঙ্গে মূলানুগ ও সুললিত। কাওয়াবাতার লেখার মতো জাপানী স্বাদগন্ধের গভীরতায় ভরা সাহিত্যর বিষয় ও বাকপ্রতিমাকে পশ্চিমী ভাষা ও সংস্কৃতিতে অনুবাদ করার সমস্যা বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ইংরাজী মারফৎ ঘুরপথে জাপানী উপন্যাসের অনুবাদ পড়তে হলে আমাদের বাড়তি যে অসুবিধে তৈরি হতে পারে, ঠাকুর দম্পতীর এই অনুবাদ তা থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছে। আমরা এই অনুবাদ থেকে কাওয়াবাতার বিষয় গভীরতা ও বাকরীতিকে অনেকটাই স্পর্শ করতে পারি বলে জাপানী ভাষাবিশেষজ্ঞ অনেক বাঙালি সাহিত্যবিদ যে মত প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের মতো জাপানী ভাষায় অনভিজ্ঞ পাঠককে ভরসা দেয়।